Ad

দ্বীন প্রচারে জয়-পরাজয়ের ভাব ।

 

জয়-পরাজয়ের ভাব

একটা মহান উদ্দেশ্যকে কার্যকরী করা আপনার লক্ষ্য। আপনি চাচ্ছেন অন্যান্য মানুষও আপনার আদর্শের অনুসারী হোক। আপনার কথা তাদের অন্তরে প্রভাব বিস্তার করুক। সুতরাং এ উদ্দেশ্যে আরো কিছু পরামর্শ রাখা হচ্ছে। এগুলোর প্রতিও আপনার লক্ষ্য করা উচিত।

একটা দৃষ্টান্তের মাধ্যমেই একথা পরিষ্কার হয়ে যাবে। একদিন জনৈক আলেমের সঙ্গে আমি এক দাওয়াতে গিয়েছিলাম। যথারীতি খাওয়া-দাওয়ার পর সকলে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনায় রত। এমন সময় আমি লক্ষ্য করলাম, এক পাশে জনৈক ভদ্রলোক কথার মাধ্যমে বেশ বাগ্মিতা দেখাচ্ছে। তার বর্ণনাভঙ্গীতে মনে হচ্ছিল সে যেন তার বিদ্যার বহর দেখিয়ে সবার ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। একবার কথা প্রসঙ্গে বলল, কুরআনে আল্লাহ বলেছেন “আল-আ’মালু বিন্নিয়্যাত” –(কাজের ফলাফল নিয়তের উপর নির্ভরশীল) আমি এবার ভালোভাবে ঐদিকে কান পেতে তার কথাগুলো লক্ষ্য করতে লাগলাম। প্রথমতঃ আমি যে বুজুর্গের সঙ্গে দাওয়াতে গিয়েছিলাম, তার প্রতি একবার তাকালাম। উদ্দেশ্য, দেখি তিনি ঐ ব্যক্তির এ উদ্ধৃতির কোন প্রতিবাদ করেন কিনা। কিন্তু যখন দেখা গেল যে তিনি এ ভুলের কোনই প্রতিবাদ করলেন না, তখন আমি অত্যন্ত বিস্মিত হলাম। ইনি হয়তো আঁচ করতে পেরেছেন যে, তার ভুলটি কোন জায়গায়। আমার মতো একজন সামান্য পড়ুয়া লোক একথা জানে যে,“আল আ’মালু বিন্নিয়্যাত” এটা কুরআনের আয়াত নয়। কেননা কুরআনের কোথাও এ বাক্যটি নেই। বরং এটা একটা বিখ্যাত হাদীস যা প্রায় সকল হাদীস গ্রন্থের প্রারম্ভেই লিপিবদ্ধ থাকে। কত মস্ত বড় ভুল! যদি প্রকাশ্যভাবে তার এ ভুল নির্দেশ করা হতো, নিশ্চয় সে সকলের সামনে অত্যন্ত লজ্জা পেয়ে যেত এবং নিজেকে সবজান্তা বলে প্রমাণ করার যে চেষ্টা করছিল, তা ফেসে যেত। কিন্তু আমি দেখলাম, আমার সঙ্গী শ্রদ্ধেয় আলেম সাহেব এ সম্পর্কে কিছু বলছেন না। ঐ ব্যক্তি তার মনগড়া কথায় একাধারে যা ইচ্ছে বলেই যাচ্ছে। একেকবার আমার ইচ্ছে হচ্ছিল যে, তার মাতব্বরীর ঘটিটা ভেঙ্গে দেই; কিন্তু আমি কি করবো না করবো চিন্তা করতে করতেই সে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেছে। কথা পুরনো হয়ে গেছে ভেবে নীরব থাকলাম। দাওয়াত থেকে ফেরার পথে আমি আলেম সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম : “আচ্ছা লোকটি অত বড় ভুল করা সত্ত্বেও আপনি কিছু বললেন না কেন? যে ব্যক্তি “আল-আ’মালু বিন্নিয়্যাত” কে কুরআনের আয়াত বলে উল্লেখ করে, তার যে এলেমের দৌড় কি পরিমাণ তা তো পরিষ্কারই বুঝা যায়। “ মাওলানা সাহেব তখন আমাকে বললেন, সে সময় তাকে লজ্জা দেয়াটা আমি পছন্দ করলাম না। কেননা এমতাবস্থায় সে আমার প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার পরিবর্তে আমার থেকে দূরেই সরে যেত। তাছাড়া এটাও চিন্তা করার বিষয়, সে তো আমাকে একথা জিজ্ঞাসা করেনি যে,“আল-আ’মালু বিন্নিয়্যাত” কি কুরআনের আয়াত,না হাদীসের অংশ?”

আমার সে বন্ধু মাওলানা সাহেব আজ ইহজগতে নেই। আল্লাহ তাকে জান্নাত নসীব করুন। কিন্তু তার কথা এখনও আমার হৃদয়ে অংকিত হয়ে আছে। অনেকেরই এ জাতীয় উপদেশাবলীর প্রয়োজন রয়েছে, যা সে বুজুর্গ ব্যক্তি আমাকে বলেছিলেন। এটা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি যে, মানুষ সর্বদা অপরের সঙ্গে কথায় কথায় জড়িত হয়ে পড়ে। অপরের সঙ্গে বিতর্কে জড়িত হওয়ার প্রবণতা অধিকাংশ মানুষের মধ্যে দেখা যায়। প্রত্যেক মানুষই সুযোগ পেলেই অপরের সমালোচনা করে তৃপ্তি পায়। তর্ক-বিতর্কের জোড়ে সবাই সুমতের প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা করে। কিন্তু আপনি যদি একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করেন তাহলে উপলব্ধি করতে পারবেন যে, তর্কে জয়ী হওয়ার জন্য একটা মাত্র পথই সর্বোত্তম, আর তা হচ্ছে মানুষের সাথে তর্ক করা থেকে দূরে অবস্থান করা। যেমন মানুষ অনিষ্টকর জন্তু-জানোয়ার এবং সাপ-বিচ্ছু থেকে দূরে অবস্থান করে। নিরানব্বই ভাগ তর্ক-বিতর্কের ফলাফলই এমন দেখা গেছে যে, এত কিছু বিতর্কের পরও উভয় পক্ষ মনে করে যে, তাদের নিজেদের যুক্তিই ঠিক এবং নির্ভুল। আপনি কোনদিনই তর্কে জয়ী হতে পারবেন না। পরাজয় বরণ করলে তো করলেনই আর জয়ী হলেও দেখতে পাবেন আপনি পরাজিত। কেননা এ অবস্থায় আপনি তো এটাই প্রমাণ করেছেন যে, আপনার প্রতিপক্ষ অজ্ঞ। এতে আপনি কিছুক্ষণের জন্য আনন্দিত হয়েছেন বটে, কিন্তু তর্কে আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীর হৃদয় টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। আপনি তাকে খাটো এবং হেয় প্রতিপন্ন করেছেন। তার স্বাবলম্বিতা এবং ব্যক্তিত্বে আপনি প্রচণ্ড আঘাত হেনেছেন। তাকে ব্যথিত করেছেন। তাকে আপনি বাধ্য করেছেন তার মর্জিবিরোধী বিষয় মানার জন্যে। এতে তার মতের আদৌ পরিবর্তন সাধিত হয়নি। তার বদ্ধমূল ধারণা বিন্দুমাত্রও বদল হয়নি। আজীবন লালিত-পোষিত কারো বদ্ধমূল ধারণার পরিবর্তন তর্ক-বিতর্কে জয়ী হওয়ার মাধ্যমে আদৌ সম্ভব নয়। এতে কোনদিনই মানুষের মতের পরিবর্তন হতে পারে না। বড়জোড় প্রতিপক্ষ সাময়িকভাবে আপনার কথা স্বীকার করে নিতে পারে, কিন্তু তা একমাত্র দায়ে ঠেকে-তর্কের মারপ্যাঁচে পড়ে। এমনকি তর্ক-বিতর্কে আপনি কোন নিরক্ষর অশিক্ষিত ব্যক্তিকেও প্রভাবিত করতে পারবেন না। অবশ্য তাকে আপনি লা-জওয়াব করতে পারবেন। অশিক্ষিতের কথা দূরে থাকুক, অনেক সময় শিক্ষিত ব্যক্তিদের বেলায়ও দেখা যায় -আপনি তার সম্মুখে এমন স্পষ্ট যুক্তি প্রমাণাদি উপস্থাপন করেছেন, যা বিনা দ্বিধায় তার মেনে নেয়া উচিত। কিন্তু তবুও সে তা মানছেনা, বরং উল্টো পাল্টাভাবে সে এমন বিতর্ক জুড়ে দেয়, যাতে শেষ পর্যন্ত বিতর্ক অত্যন্ত দীর্ঘ হয়ে যায়। আলোচ্য বিষয় থেকে আলোচনা বহুদূরে সরে যায়। ফলে বক্তারও আর নীতি ঠিক থাকে না যে, সে কি করবে। আর শ্রোতা তো শুধু নিজের কথাই বলে যায় এবং বিষয়বস্তু থেকে নিজেকে বহুদূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। নিজেকে এমন অবস্থার সম্মুখীন হতে দেয়া কিছুতেই আপনার জন্য বাঞ্ছনীয় নয়। কেননা এ জাতীয় অবস্থা আপনার মহান লক্ষ্যে পৌঁছার পথে মস্তবড় প্রতিবন্ধক ও ক্ষতিকর। তবে ঘটনাক্রমে কোথাও এমন অবস্থার সম্মুখীন যদি হয়েই যান, সে সময় তার থেকে গা বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করা উচিত। সামান্য বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করলেই এমন পরিস্থিতিকে পরিবর্তন করতে পারেন।

নিম্নের একটি দৃষ্টান্ত দেখুন-

জনৈক ব্যবসায়ী ব্যক্তির সঙ্গে কোনো ইনকাম ট্যাক্স অফিসার তর্কে প্রবৃত্ত হলেন। অফিসার সাহেব এমনএকটা বিষয়ের ওপর ট্যাক্স ধার্য করতে চাচ্ছেন, আইনের বিধান মতে যেখানে ট্যাক্স ধার্য করার কোনো অবকাশ নেই। ব্যবসায়ী ব্যক্তি বহু চেষ্টা করেদেখলেন যে, ইনকাম ট্যাক্স অফিসারকে কোনোক্রমে বুঝাতে সক্ষম হচ্ছেন না, বরং যতই তাকে বুঝানোর চেষ্টা করা হয়, তত বেশী তিনি বাদানুবাদ শুরু করে দেন এবং ক্ষেপে ওঠেন। ঝগড়া বাড়তেই থাকলো। ব্যবসায়ী বুঝতে পারলেন যে, বিষয়টা শেষ পর্যন্ত একটা বাদানুবাদ এবং বিতর্কে পরিণত হচ্ছে । তিনি তখন ঝট করে অন্যদিকে কথার মোড় পরিবর্তনের চেষ্টা করলেন। বললেন, দেখুন অফিসার সাহেব, আপনারা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যতো গুরুত্বপূর্ন কাজ করে থাকেন তার তুলনায় এই বিষয়টি তো কিছুই নয়। এটা সাধারণ তুচ্ছ ব্যাপার মাত্র। এ নিয়ে অতো বাড়াবাড়িটা উচিত হচ্ছেনা। আইন-কানুনের ব্যাপারে আপনাদের যে দক্ষতা আছে আমার সেটা নেই, হতেও পারে না। কেননা আমরা তো শুধু বই-ই পড়েছি আর আপনারা নিজেরাই এ নিয়ে সকাল-সন্ধ্যা পর্যন্ত চর্চা করেছেন। বই এর জ্ঞান আর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আকাশ-পাতাল তফাত। আইন-কানুন বুঝার ব্যাপারে আমারও যদি এমন সুযোগ ঘটতো, তাহলে  হয়তো আমিও ঐ ধারাটির অর্থ তেমনই বুঝতাম, যেমন আপনি বুঝেছেন। যা হোক এখন কথা হচ্ছে, এ ব্যাপারে আমাকেও চিন্তা করতে দিন এবং আপনিও বিষয়টা আরো একটু গভীরভাবে চিন্তা করুন। হয়তো আপনার অভিজ্ঞতার আলোকে এমন কোনো পথ খুলে যেতে পারে যাতে আমাকেও সন্তুষ্ট করতে আপনি সক্ষম হবেন। এখন এ ব্যাপারে আর অধিক আলোচনা না করে অন্য সময় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলেই আমার মনে হয় সবচাইতে ভাল হয়। ব্যবসায়ীর এ কথার অফিসার সাহেব এখন কিছুটা নরম হলেন। আলোচনার গতিও অন্য দিকে মোড় নেয়। আফিসার সাহেব এখন নিজের যোগ্যতার বাহার দখানোর জন্যে এমন কতিপয় ব্যক্তির কথা উল্লেখ করতে লাগলেন সাধারণতঃ যারা তাকে ধোঁকা দিয়েছে এবং তিনি তাদেরকে ধরতে পেরেছেন।

এভাবে আলাপ-আলোচনার পর অবশেষে উভয়ে মধ্যে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ আলাপ চলতে লাগলো। ব্যবসায়ী ব্যক্তিটি চলে যেতে উদ্যত হলে, অফিসার সাহেব তার সঙ্গে অঙ্গীকার করলেন আচ্ছা আমি আপনার বিষয়টা পুনর্বিবেচনা করে দেখবো। তিন দিন পর যখন আবার ব্যবসায়ী ব্যক্তি ঐ অফিসারের সঙ্গে সাক্ষাত করলো তখন বিনা বাক্য ব্যয়ে অফিসার সে কথাই মানতে রাজী হলেন যা ঐদিন বহু তর্কবিতর্কের পরও তিনি মানতে প্রস্তুত ছিলেন না। তার একমাত্র কারণ ছিল যে, সে একজন সরকারী অফিসার হয়ে সাধারণ ব্যবসায়ীর নিকট তার অজ্ঞতার পরিচয় দিয়ে তার কাছে নতি স্বীকার করবেন! কেননা এতে প্রমাণিত হবে যে, সংশ্লিষ্ট অফিসার অপেক্ষা একজন ব্যবসায়ী আইনের তাৎপর্য ভালো ভাবে উপলব্ধি করতে পারে। এ জন্যেই নিজের মর্যাদা বহাল এবং দুর্বলতাকে ঢেকে রাখার জন্য প্রস্তুত হয়ে তর্কে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন এবং কোনো অবস্থাতেই ব্যবসায়ীর কথা সমর্থন করতে প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু যখনই অন্যভাবে তার মর্যাদার স্বীকৃতি পেলো এবং দুর্বলতা ঢাকা পড়লো, তখনই তার যাবতীয় রোষানল ক্ষনিকের মধ্যে ঠান্ডা হয়ে গেলো এবং তার মন ন্যায় ও সত্যকে মেনে নিতে প্রস্তুত হলো। অনুরুপভাবে এমন বহুশিক্ষিত লোকের সঙ্গে আপনার সাক্ষাত ঘটবে। আপনি যদি তাদের সন্মুখে কোনো নির্ভুল যুক্তিও পেশ করেন কিন্তু তারা এ সত্যকে স্বীকার করে আপনার নিকট নতি স্বীকার করতে রাজি হবে না, রাজি হবেনা নিজেকে কম জ্ঞানী বলে স্বীকার করতে। পক্ষান্তরে আপনি যদি এমন কোনো কর্মপন্থা অবলম্বন করেন, যাতে তার জ্ঞানানুভূতি আহত না হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে আপনি তাকে নিজের যুক্তি মানতে বাধ্য করতে পারবেন। বিশেষভাবে আর একটা কথা আপনি স্বরণ রাখবেন, আপনি সর্বদা আলেম, ধর্মীয় নেতা, গ্রাহক, স্বামী-স্ত্রী এদের কাছে তর্কে পরাজয় বরণ করতে চেষ্টা করবেন। কেননা এ ময়দানে আপনার জয়ী হওয়া অপেক্ষা পরাজয় বরণ করাতেই লাভ অধিক। মনে রাখবেন, দুনিয়ায় যারা গঠন মূলক কিছু কীর্তি রেখে যেতে চায়, সাধারণ কথা নিয়ে তাদের ঝগড়া করার সময়টাই বা কোথায়? ছুটন্ত ঘোড়াকে পথ ছেড়ে দেয়াই উত্তম। অন্যথায় রাস্তা বন্ধ করে দিলে নিজের গায়ে চোট লাগার সম্ভাবনা রয়েছে। এক কথায় বিতর্কে জয়ী হওয়ার ইচ্ছা করার পরিবর্তে ওখান থেকে দূরে থাকাই ভালো।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url