Ad

মনের কুচিন্তা ও সুচিন্তা।

কুচিন্তা ও সুচিন্তা

আগেও বলা হয়েছে যে, দেহের দাবিতে মনে কুচিন্তা জন্মে। কিন্তু বিবেক তা সমর্থন করে না। যারা নৈতিকতার ধার ধারে না তাদের বিবেক দুর্বল। তারা ইচ্ছা করেই কুচিন্তাকে প্রশ্রয় দেয়। মনের পবিত্রতার কোন মূল্য তাদের কাছে নেই। এ জাতীয় লোকদের সম্পর্কে এখানে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন।

যারা সুচিন্তা করা পছন্দ করে শয়তান তাদের মনেও সময় সময় মানবীয় দূর্বল মুহুর্তে কুচিন্তা ঢুকিয়ে দেয়। কিন্তু যারা আল্লাহর দাস হিসাবে জীবন যাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা অবশ্যই কুচিন্তাকে মন থেকে তাড়ানোর চেষ্টা করে। কোন সময় যদি ঐ কুচিন্তা মন্দ কাজে লিপ্ত করেই ফেলে তখন তারা অনুতপ্ত হয় এবং তাওবা করে। তারা স্থায়ী ভাবে নাফসের নিকট আত্মসমর্পণ করে না।

যারা সুচিন্তায় অভ্যস্ত তাদেরকে নামাযের সময় ইবলিস নামাযের বাইরের কোন সুচিন্তা মনে ঢুকিয়ে হলেও নামায থেকে অমনোযোগী করে দেওয়ার চেষ্টা করে। তাই নামাযে যে চিন্তা মনে জারি থাকা দরকার তাতেই একাগ্র হতে হবে, নামাযের বাইরের কোন ভাল চিন্তাকেও প্রশ্রয় দেয়া ঠিক নয়। সাধারণত করণীয় বিভিন্ন কাজের ব্যাপারে ভাল চিন্তা এসে নামাযের চিন্তাকে সরিয়ে দেয়। কিন্তু বাইরের সুচিন্তাও জীবন্ত নামাযের জন্য ক্ষতিকর। নামাযে শুধু নামাযের চিন্তাই থাকা উচিত।

দুশ্চিন্তা

কোন মানুষই দাবি করে বলতে পারে না যে,তার জীবনে সমস্যা নেই। সম্পূর্ণ রোগহীন দেহ ও সমস্যামুক্ত জীবন অবাস্তব। জীবনে আপদ বিপদ ও সমস্যার অন্ত নেই। জীবনের আরেক নামই সমস্যা। জীবন সংগ্রাম মানেই হলো জীবন সমস্যার সমাধানের প্রচেষ্টা চালানো। সমস্যা আছে এবং থাকবে জেনেই সমাধানের চেষ্টা চালাতে হয়।

দুশ্চিন্তা কাকে বলে? দুঃখ দৈন্য, আপদ বিপদ ও দুর্ঘটনার ফলে যে পরিস্তিতির সৃষ্টি হয় তা থেকে উদ্ধারের পথ পাওয়ার জন্য যে পেরেশানী ও অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, এরই নাম দুশ্চিন্তা। হায় আমার কী হবে? বাঁচার কোন উপায়ই দেখছি না। এর পরিণতি কী? এ জাতীয় চিন্তাকেই দুশ্চিন্তা বলে। দুশ্চিন্তা এমন এক রোগ যে, একে প্রশ্রয় দিলে চরম হতাশা সৃষ্টি হতে পারে। হতাশার চরম পর্যায়ে মানুষ আত্মহত্যা করার মতো চরম দুর্বলতাও প্রদর্শন করে বসে।

দুশ্চিন্তা কিন্তু সমস্যার সমাধানে সামান্য সাহায্যও করে না বরং সমস্যাকে আরও জটিল করে। ধীরচিত্তে ও স্থির মস্তিষ্কে সমাধান তালাশ করতে হয়। অস্থির চিত্ত কখনও সমাধান খুঁজে পায় না। দুশ্চিন্তা চিন্তার ভারসাম্য বিনষ্ট করে বলে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছায় না। এমনকি এ রোগ সমাধানের কোন নির্দিষ্ট পথকেই চূড়ান্তভাবে গ্রহণ করতে দেয় না। একেকবার একেক রকম পথ ধরার চেষ্টা করে বলে ব্যক্তি ধৈর্যের সাথে কোনো পথ চলতে সক্ষম হয় না। তাই দুশ্চিন্তা হলো চিন্তার বিকৃতি।

আল্লাহ তা’আলা তাঁর মুমিন বান্দাহদেরকে দুশ্চিন্তার মুসীবত থেকে রক্ষার জন্য এমন কতক মূলনীতির কথা ঘোষণা করেছেন, যা মেনে নিলে শত মুসীবতেও মানসিক ভারসাম্য বজায় রেখে চলা সম্ভব।

১. কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে,

ما أَصابَ مِن مُصيبَةٍ إِلّا بِإِذنِ اللَّهِ ۗ وَمَن يُؤمِن بِاللَّهِ يَهدِ قَلبَهُ

আল্লাহর বিনা অনুমতিতে কোন মুসীবত আসে না। যে আল্লাহকে বিশ্বাস করে আল্লাহ তার কালবকে হেদায়াত দান করেন। (সূরা তাগাবুন: ১১)

ব্যাপার এমন নয় যে, কোন বিপদ আল্লাহ ঠেকাতে পারলেন না বলে এসে গেল। বরং আল্লাহ বিপদ দেবার সিদ্ধান্ত করলেই তা আসে। যদি কেউ এ কথা বিশ্বাস করে তাহলে সে অস্থির না হয়ে ধৈর্যধারণ করবে এবং বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য আল্লাহর দরবারেই ধরণা দেবে। আল্লাহর উপর সঠিক আস্থা ও বিশ্বাস থাকলে বিপদের সময় কেমন আচরণ করতে হবে সে বিষয়ে আল্লাহ সঠিক হেদায়াত দান করেন।

মুসীবত থেকে উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টা করাও কর্তব্য। শান্ত মনে ভেবে-চিন্তে চেষ্টা তদবীর করতে হবে। সঠিক পদ্ধতিতে যাতে তদবীর করা যায় সে জন্য কাতরভাবে দোয়াও করতে হবে। কোন তদবীর ফলপ্রসু না হলেও হতাশ না হয়ে মহান মনিবের নিকটই সঠিক পথ চাইতে হবে।

২. আলাহ  তা’আলা কুরআন মাজীদে বলেন,

وَإِن يَمسَسكَ اللَّهُ بِضُرٍّ فَلا كاشِفَ لَهُ إِلّا هُوَ

‘হে রাসূল! আল্লাহ যদি আপনার উপর কোন মুসীবত দেন তাহলে তিনি ছাড়া তা দূর করার ক্ষমতা অন্য কারো নেই’। (সূরা ইউনুস : ১০৭)

যত চেষ্টা-তদবিরই করা হোক, মুসীবত থেকে উদ্ধার করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর হাতে। এ অবস্থায় অস্থির হওয়া, হতাশা প্রকাশ করা বা আল্লাহর উপর অসন্তুষ্ট হওয়ার দ্বারা মানসিক যন্ত্রণা পাওয়া ছাড়া আর কোন লাভ হয় না।

৩. কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে-

‘আল্লাহর উপর ভরসা করাই মুমিনদের কর্তব্য’ এ কথাটি বিভিন্ন ভঙ্গিতে বহু সূরায় উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা তার মুমিন বান্দাদেরকে বার বার তাকীদ দিয়েছেন যে, তোমরা একমাত্র আমার উপর ভরসা কর। বৈধ পথে চেষ্টা তদবীর অবশ্যই করতে থাক। তবে ঐ তদবীরের উপর আসল ভরসা যেন না হয়। তাহলে হতাশায় ভুগতে বাধ্য হবে।

আসলে আল্লাহর উপর আস্থা রাখাই হলো ভরসা বা তাওয়াক্কুল। মুমিন কোন অবস্থায়ই আল্লাহর উপর আস্থা হারায় না। এ আস্থা রাখতেই হবে যে,আমার মেহেরবান আল্লাহ আমার মঙ্গলই করবেন। যদিও আমি বুঝতে পারছি না যে, আমার মুসীবতের মাধ্যমে কী মঙ্গল হতে পারে। তবে এ আস্থা আছে যে, আল্লাহ অমঙ্গল করেন না। বিতরের নামাযে দু’আ কুনুতে এ আস্থার কথাই আমরা প্রতিনিয়ত ঘোষণা করি এ ভাষায়-

‘হে আল্লাহ! তোমার উপর ঈমান রাখছি,তোমার উপর ভরসা করেছি এবং তুমি মঙ্গলময় বলেই আমি প্রশংসা করি।’

অর্থাৎ তুমি যা কিছুই কর তাতে আমার মঙ্গল হবে বলেই বিশ্বাস করি। এ বিশ্বাস ছাড়া হতাশার যাতনা থেকে মুক্তির কোন উপায়ই নেই।

৪. কুরআন মাজীদে আরো বলা হয়েছে- الَّذينَ آمَنوا وَتَطمَئِنُّ قُلوبُهُم بِذِكرِ اللَّهِ ۗ أَلا بِذِكرِ اللَّهِ تَطمَئِنُّ القُلوبُ

আল্লাহর প্রতি অনুরাগী তারা, যারা ইমান গ্রহন করেছে এবং আল্লাহর যিকরের মাধ্যমে তাদের অন্তর প্রশান্তি লাভ করে। জেনে রাখ, ‘একমাত্র আল্লাহর যিকরেই অন্তর সন্ত্বনা লাভ করে।’ (সূরা রাদ: ২৮)

হাজারো মুসীবতের মধ্যে ও আল্লাহকে ডেকে তাঁর দরবারে ধরণা দিয়ে এবং তাঁর নিকট আশ্রয় চেয়েই মনে প্রশান্তি লাভ করা সম্ভব। সূরা আল ফাতিহায় ‘একমাত্র তোমারই দাসত্ব করি এবং একমাত্র তোমারই কাছে সাহায্য চাই’ বলার উদ্দেশ্যও তাঁরই আশ্রয় কামনা করা।

ঈমানদারের জন্য দুশ্চিন্তা অত্যন্ত মারাত্মক রোগ। কারণ আল্লাহপাক বিপদ মুসীবত সম্পর্ক কুরআনে যে ধারণা দিয়েছেন, তা বিশ্বাস করলে দুশ্চিন্ত থাকার কথা নয়। ঈমানের দাবিদার হয়েও দুশ্চিন্তাকে প্রশ্রয় দিলে ঐ ৪টি মূলনীতিকেই অবিশ্বাস ও অগ্রাহ্য করা হয়। তার দুশ্চিন্তার অর্থ দাঁড়ায় এই যে-

১. আমার উপর এই মুসীবত দিয়ে আল্লাহ আমার উপর অবিচার করেছেন। এটা করা মোটেই উচিত হয়নি।

২. এ মুসীবত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য আল্লাহর দয়ার অপেক্ষা করার ধৈর্য আমার নেই। আমাকেই কিছু করতে হবে এবং যেমন করেই হোক এ থেকে উদ্ধার পেতে হবে।

৩. এ মুসীবতের মধ্যেও আমার জন্য কোন মঙ্গল থাকতে পারে তা আমি স্বীকার করি না। যারা আমার এ মুসীবতের জন্য দায়ী তাদেরকে আমি ক্ষমা করব না। সুযোগ পেলেই দেখে নেব।

৪. সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করেই মনে শান্তি পেতে হবে বলে যা বলা হয়, তা কী করে সম্ভব? আমার মনে যাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ রয়েছে তা আমি কেমন করে ভুলব? আর আল্লাহকে এত ডেকেই কী হবে? আল্লাহ তো সাড়া দিচ্ছেন না। আর কত ডাকব। এ ভাবে দুশ্চিন্তাকে প্রশ্রয় দিলে ঈমান হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। তাই দুশ্চিন্তা থেকে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে আল্লাহর শেখানো নিয়মে মনকে ইতিবাচক কাজ দিন। তাহলে দুশ্চিন্তা মনকে ভারাক্রান্ত করার সুযোগ পাবে না। দুশ্চিন্তা মারাত্মক মানসিক রোগ। এ রোগ একাগ্রচিত্তে কোন কাজ করতে দেয় না, ঘুমাতে দেয় না, তৃপ্তির সাথে খেতেও দেয় না। ফলে দৈহিক ও স্নায়ুবিক বিরাট ক্ষতি সাধন করে।

দুশ্চিন্তার ফলে অনেক সময় নিজের উপরই রাগ হয়। মুসীবতের জন্য অন্যদেরকে দায়ী করলে তাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। এমনকি দুশ্চিন্তা আল্লাহর উপরও অসন্তুষ্ট হতে বাধ্য করে। আল্লাহর প্রতি অভিমান বশে আল্লাহকে নির্দেশ দেয় যে- হয় এটা কর, না হয় ওটা কর। এ সবের কোনটাই সুস্থ মনের পরিচায়ক নয়। আল্লাহর উপর পূর্ণ আত্মসমপর্ণই দুশ্চিন্তা থেকে নিস্তার পাওয়ার একমাত্র উপায়। দুশ্চিন্তার মাধ্যমে শয়তান আপনার মনের উপর রাজত্ব করছে। শয়তানকে উৎখাত করে আল্লাহর রাজত্ব মনের মধ্যে কায়েম করুন। মনে শান্তি পাওয়ার এটাই একমাত্র পথ।

মনের সাথে চোখের সম্পর্ক

মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে চোখকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। চোখকে ক্যামেরার লেন্সের সাথে তুলনা করলে মনকে ক্যামেরার ফিল্মের সাথে তুলনা করা যায়। ক্যামেরার লেন্স যা দেখে তাই ভেতরের ফিল্মে ছবি হয়ে যায়। তেমনি চোখের লেন্স দিয়ে যা দেখা হয় তাই মনের ফিল্মে ছবি হয়ে ফুটে ওঠে। তাই মনকে পবিত্র রাখতে হলে অপবিত্র দৃশ্য দেখা থেকে চোখকে ফিরিয়ে রাখতে হবে।

কুরআনে মুমিনদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, পরনারীর উপর চোখ পড়ার সাথে সাথে নামিয়ে নিতে হবে এবং আবার দেখা থেকে চোখকে ফেরাতে হবে। যেসব মহিলার সাথে বিয়ে জায়েজ নয় তারা ছাড়া অপর মহিলার দিকে মনোযোগ দিয়ে দেখলে তার ছবি মনে অংকিত হয় এবং সে ছবি মনকে অপবিত্র করতে থাকে। রাস্তা-ঘাটে বা পত্র-পত্রিকায় নৈতিকতার দৃষ্টিতে আপত্তিকর যত রকম দৃশ্য চোখে পড়ে তার প্রতি মনে ঘৃণা জন্মাতে হবে এবং সেসব থেকে সযত্নে চোখকে বাঁচিয়ে চলতে হবে। তাহলে মনের পবিত্রতা রক্ষা করা সহজ হবে।

তসবীহ পড়া বা যিকর করার সময় চোখ বন্ধ রাখলে মনের একাগ্রতা বহাল রাখা সহজে সম্ভব হয়। কারণ চোখ যা দেখে মনকে সে তা দেখায়। নামাযে সব সময় চোখ বুজে থাকা মাকরুহ বলে চোখ বন্ধ রাখার ফাঁকে ফাঁকে চোখ খুলতে হবে। মনকে নামাযে নিবদ্ধ করার প্রয়োজনে চোখ বন্ধ রাখা জায়েয। সব সময় চোখ বুজে নামায আদায় করলে চোখের ট্রেনিং হয় না। নামাযের বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে দেখার বিধান রয়েছে যাতে চোখকেও আল্লাহর হুকুম এবং রাসূলের তরীকা অনুযায়ী ব্যবহার করার ট্রেনিং হয়। এ ট্রেনিং এর উদ্দেশ্য হলো নামাযের বাইরে চোখকে আল্লাহর হুকুম ও রাসুলের তরীকা মেনে চলার যোগ্য বানানো। যাদের নিকট মনের পবিত্রতা রক্ষারও গুরুত্ব রয়েছে তাদেরকে চোখের নিযেন্ত্রণে অবশ্যই সচেষ্ট হতে হবে।

মনের অবসর সময়ের কাজ

অংগ প্রত্যঙ্গ দিয়ে আপনি যখন কাজ করেন তখন ঐ কাজটি ভালভাবে সমাধা করার জন্য মনোযোগ দিয়েই কাজটি করতে হয়। অবশ্য এটা কাজের ধরনের উপর অনেকটা নির্ভর করে। কৃষক ও শ্রমিকদেরকে শুধু হাত-পা ব্যবহার করে গতানুগতিক ধরনের এমন কাজও করতে হয় যে কাজে মনের তেমন কোন দায়িত্ব থাকে না। রিকশাওয়ালার দেহ রিকশা টেনে নিয়ে যাবার সময় এ কাজে মনের তেমন কোন দায়িত্ব নেই বলে তখন হাজারো ভাব মনে জাগতে পারে।

কিন্তু হাত যখন কলম দিয়ে লেখে তখন মন এ কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, মুখ যখন বক্তৃতা করে অথবা কান যখন বক্তৃতা শুনে তখন মন এ কাজেই শরীক থাকে। তাই আপনাকে হিসাব করতে হবে যে, আপনার দেহ যে কাজ করছে সে কাজে মনের দায়িত্ব কতটুকু আছে। যে কাজের সময় মন বেকার থাকে তখন তাকে কাজ দেয়া প্রয়োজন। তা না হলে আপনার অজান্তেই ইবলিশ তাকে বাজে কাজে বেগার খাটাবে। এটাই মানব জীবনের বিরাট এক সমস্যা। মন অত্যন্ত শক্তিশালী যন্ত্র। এর যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতা অসীম। কাজ ছাড়া এক মুহুর্তও সে থাকতে পারে না। তাকে সব সময়ই কাজ দেওয়ার যোগ্যতা অনেকেরই নেই। ফলে আপনার এ মূল্যবান কর্মচারী ইবলিসের বেগার খাটে। আপনার দেহ কোথাও বসে বা দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে বা পায়চারী করে কাটাতে হচ্ছে। একা একা পার্কে বা রাস্তায় ভ্রমণ করছেন। যানবাহনের অপেক্ষায় স্টেশনে বসে বা ডিউটিতে দাঁড়িয়ে আছেন। যানবাহনে চুপচাপ বসে আছেন বা বসার জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। দৈহিক পরিশ্রম করার পর ক্লান্তি দূর করার উদ্দেশ্য বসে বা শুয়ে আছেন,অথবা ঘুমের কামনায় বিছানায় চোখ বুজে পড়ে আছেন। এমন বহু সময় রোজই আমাদের জীবনে কেটে যায় যখন সচেতনভাবে আমরা মনকে কোন বিশেষ চিন্তায়, ভাবনায় বা পরিকল্পনা রচনায় ব্যবহার করি না। মনকে আমরা এভাবে যখনই বেকার রেখে দেই তখন সে ইবলিশের বেগার কর্মচারীতে পরিণত হয়।

এর প্রতিকার হিসাবে রাসূল (সা) একটি ইতিবাচক ও একটি নেতিবাচক উপদেশ দিয়েছেন। নেতিবাচক উপদেশটির সারমর্ম হলো, তোমরা আল্লাহকে লজ্জা কর। মনে এমন ভাব আসতে দিওনা, যা আল্লাহ অপছন্দ করেন। আল্লাহ মনের গোপন ভাবও জাননে। তাই এ কথা খেয়াল রাখবে যে, এমন কথা আমি মনে কী করে স্থান দিতে পারি, যা আমার মনিব অপছন্দ করেন? এভাবে লজ্জাবোধ করলে মনকে বাগে রাখা যায়।

আর ইতিবাচক উপদেশ হলো জিহ্বাকে সব সময় আল্লাহর যিকরে চলমান রাখ। মনে খারাপ ভাব আসতে না দিলে মুখের যিকর মনকে যিকরে মশগুল রাখবে। অর্থাৎ মন ও মুখ কোনটাই খালি রাখা নিরাপদ নয়। মুখের যিকর মনকে যিকর করতে সাহায্য করে। মনকে দেওয়ার মতো কোন কাজ না থাকলে তাকে যিকরে ব্যস্ত করে দিতে হবে এবং এ উদ্দেশ্য সফল করার জন্য মুখেও যিকর জারী করা দরকার।

যিকরের ব্যাপারে একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। হাদীসে শুধু ‘আল্লাহ,আল্লাহ’ যিকরের কোথাও শিক্ষা দেয়া হয়নি। আল্লাহ শব্দের সাথে আল্লাহর কোন একটি গুণ থাকা দরকার। যেমন -সুবহানাল্লাহ,আল-হামদুলিল্লাহ,আল্লাহু আকবার, লা- ইলাহা ইল্লাহ ইত্যাদি। বুখারী শরীফের শেষে একটি চমৎকার তসবীহ শেখানো হয়েছে। রাসূল (সা) বলেন, ‘দুটো বাক্য এমন আছে যা মুখে উচ্চারণ করা খুব সহজ, কিন্তু দাঁড়িপাল্লায় বেশ ভারী এবং আল্লাহর নিকট বড় প্রিয়’ তাহলো -‘সুবহানাল্লাহি ওয়াবিহামদিহী সুবাহানাল্লাহিল আযীম।’

কতক বাস্তব পরামর্শ

খালি মনকে ব্যস্ত রাখার জন্য আমার ব্যাক্তিগত দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে কতক পরামর্শ পেশ করছিঃ

১. সব সময় সব অবস্থায় ইসলামী বই সাথে রাখুন, যখনই মন অবসর হয়ে যায়, ঐ বই পড়ুন। এটা যিকর থেকেও বেশি কার্যকর পন্থা। যিকরে মনোযোগের অভাব হতে পারে। পড়ার সময় তা হয়না। তাছাড়া সকল রকম নফল ইবাদতের মধ্যে দ্বীনের ইলম তালাশ করা শ্রেষ্ঠতম।

২. অনেক সময় বই পড়ার পরিবেশ বা সুযোগ থাকে না। তখন কয়েকটি কাজ করতে পারেনঃ

(ক) কুরআন মাজীদের মুখস্থ করা সূরাগুলো আওড়াতে থাকুন। পরিবেশ অনুকুল থাকলে গুনগুন করেই পড়ুন।

(খ) কালেমা তাইয়্যেবা, তিন তাসবীহ,দরুদ বা যে কোন যিকর মুখে ও মনে জপতে থাকুন।

(গ) আপনার করণীয় কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে করার পরিকল্পনা প্রসঙ্গে চিন্তা করুন। কারো সাথে আলোচনার কথা থাকলে বিষয়টি মনে মনে গুছিয়ে নিন।

(ঘ) নিঃশ্বাস টানার সময় সচেতনভাবে ‘লা-ইলাহা ‘এবং নিঃশ্বাস ছাড়ার সময় ‘ইল্লাল্লাহ’ নিঃশব্দে মনে মনে পড়তে থাকুন।

 

শেষ কথা

হাদীসে আছে যে, বেহেশতবাসীদের একটি আফসোস ছাড়া বেহেশতে আর কোন মনোবেদনা থাকবে না। দুনিয়াতে যে সময়টা আল্লাহকে ভুলে থেকে কাটিয়ে দেয়া হয়েছে ঐ অবহেলার জন্য আফসোস করতে থাকবে। বেহেশত তো ঐ চিরস্থায়ী বাসস্থানের নাম, যেখানে সামান্য দুঃখ-কষ্ট, অভাব পর্যন্ত থাকবে না। অথচ একটা বিষয়ে আফসোস থেকেই যাবে। আফসোস তো মনোবেদনারই সৃষ্টি করে। এ দুঃখটুকু থেকেই যাবে। সকলের বেলায় তা হয়তো সত্যি নয়। কিন্তু যাদের বেলায়ই হোক, এ বেদনাটুকুর অস্তিত্ব সত্য।

এ আফসোসের কারণ তালাশ করলে হাদীসের বিবরণ থেকে তা বোঝা যায়। আল্লাহর দীদারই বেহেশতের সকল নিয়ামতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নিয়ামত বলে বেহেশতবাসীরা মনে করবে। আল্লাহ তায়ালাকে দেখতে পাওয়ার চেয়ে বড় তৃপ্তি আর কোনটাতেই তারা বোধ করবে না। আর সবাই সমান পরিমাণ সময় আল্লাহকে দেখতে পাবে না। যে দুনিয়ার জীবনে আল্লাহকে যত বেশি স্মরণ করেছে সে তত বেশি সময় আল্লাহকে দেখার সৌভাগ্য লাভ করবে। তাই যারা কম সময় দেখার সুযোগ পাবে তারাই হয়তো ঐ রকম আফসোস করবে। তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতের ভিত্তিতে জীবন যাপনের সিদ্ধান্ত যারা নেয় তারা মানব সমাজে আল্লাহর প্রভুত্ব ও রাসূলের নেতৃত্ব কায়েমের জন্যই সংগ্রাম করে। আর এ সংগ্রামের পরিণামে আখিরাতে সাফল্যের আশা রাখে। এ সিদ্ধান্ত তাদের মন-মগয চরিত্রকে এক বিশেষ ছাঁচে গড়ে তোলে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তারা নাফসকে নিয়ন্ত্রণ করতে সচেষ্ট হয়।

যা হোক, আপনি ইসলামী আন্দোলনে সক্রিয় হোন বা না হোন, আখিরাতে মুক্তির কামনা তো নিশ্চয়ই করেন। তাহলে মনটাকে ইতিবাচক কাজ দিন। মনকে ইবলিশের বেগার কর্মচারী হতে দেবেন না। ইবলিশ থেকে মনকে রক্ষা করতে সক্ষম হলে দুনিয়া ও আখিরাতের সাফল্য অনিবার্য।

মনে রাখবেন, ইবলিশের বিরুদ্ধে এ সংগ্রাম মৃত্যু পর্যন্ত চালিয়ে যেতে হবে। এ সংগ্রাম থেকে বিরাম পাওয়ার উপায় নেই। তবে দীর্ঘ অনুশীলনের ফলে ধীরে ধীরে আল্লাহর মেহেরবানীতে ইবলিশের পরাজয় হওয়া অসম্ভব নয়। আল্লাহ তা’আলা সতর্ক করে বলেন,

إِنَّ الشَّيطانَ لَكُم عَدُوٌّ فَاتَّخِذوهُ عَدُوًّا

‘শয়তান তোমাদের দুশমন, তাকে দুশমনই মনে করবে'(সূরা ফাতির:৬) ।

আদম (আ) বেহেশতে শয়তানের ধোঁকায় এ কারণেই পড়েছিলেন যে, তিনি শয়তানকে শত্রু মনে করতে ভুলে গিয়েছিলেন। 

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url