Ad

আদর্শের প্রচারের খেত্রে সমান ব্যবহার

 

সমান ব্যবহার

আদর্শ প্রচার এবং সংস্কারমূলক কাজের প্রথম পরিসর হল প্রত্যেক ব্যক্তির নিকটতম পরিবেশ, যেখানে সে বসবাস করে চাকুরী করে অথবা অন্য কোনো ব্যাপারে অবস্থান করে। কিন্তু খুব কম সংখ্যক লোকই আদর্শের ব্যাপারে নিজেদের এ স্বাভাবিক পরিবেশে কৃতকার্য হতে পারে। এর একটা বিশেষ কারন রয়েছে। তা হলো এই যে প্রত্যেক ব্যক্তিরই এমন একটা গণ্ডি থাকে যেখানে সে একজন সরদার বা নেতার মর্যাদা পেয়ে থাকে, তার গৃহ স্ত্রী-পুত্র কর্মচারী, চাকর- চাকরাণী অনুসারী ভক্ত-অনুরক্ত ইত্যাদি বহু লোক তার কর্তৃত্বাধীনে থাকে। তাদের মধ্যে তার বিরাট প্রাধান্য এবং মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। সে তাদের মধ্যে অর্থাৎ তার নেতৃত্বের প্রভাব দ্বারা কাজ করে নিতে চেষ্টা করে। প্রয়োজনবোধে জোরজবরদস্তি ও ভীতি প্রদর্শনের পথেও সে পা বাড়ায়। মোটকথা, নিজের ব্যক্তিত্ব বলে প্রতিষ্ঠিত প্রভাব প্রয়োগে সে এ ক্ষেত্রে কিছুতেই বিরত থাকতে চায় না। এরূপ ভূমিকার পরিণতি সুস্পষ্ট। কেননা মানুষের চিন্তা বিশুদ্ধিকরণ, মতের পরিবর্তন এবং কারোর ইচ্ছা শক্তিকে নিজের সপক্ষে আনা এতো সহজ ব্যাপার নয় যে, জোরজবরদস্তি বা ভীতি পরিদর্শনের মাধ্যমে করা যেতে পারে।

প্রত্যেক ব্যক্তি তা সে আপনার অধিনস্তই হোক না কেন, তার একটা ব্যক্তিত্ব আছে। আপনার স্ত্রী-পুত্র চাকর, পরিচারিকা, কর্মচারী যারা একটা বিশেষ নিয়ম শৃঙ্খলার মাধ্যমে আপনার আনুগত্য করতে বাধ্য। তাদের ব্যক্তিগত মতামতকে নিজের মতের অধীন করার ব্যাপারে কিন্তু এ বাধ্যতা যথেষ্ট নয়। কেননা তাদেরও একটা নিজস্ব ব্যক্তিত্ববোধ রয়েছে। তাদের দৃষ্টিতে তাদের মতামতেরও বিরাট গুরুত্ব রয়েছে। তাদের মনের উপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেবার সময় বিনা যুক্তি-প্রমাণে তারা তা মানতে প্রস্তুত হয় না। তাদেরকে সন্তোষজনক যুক্তি প্রমাণ দ্বারা বুঝিয়ে দিতে হবে। অন্যথায় বিনা যুক্তিতে কোন কিছু চাপিয়ে দিতে গেলে যে ফল দাঁড়ায় এখানেও সে পরিণতি দেখা দিতে বাধ্য। কারন তাদের মধ্যেও এমন সব প্রবণতা বিদ্যমান আছে বাইরের জগতে যা আপনি সচরাচর প্রত্যক্ষ করে থাকেন। আদর্শ প্রচারের ক্ষেত্রে সত্যিই এটা একটা জটিল পর্যায়। কেননা এ স্থলে আপনার নিজের গুরুত্ব এবং ব্যক্তিত্ববোধ বর্তমান থাকে। আপনি এ ক্ষেত্রে নিজের জন্যে একটা আসন নির্ধারিত করে নিয়েছেন। সেখান থেকে নিচে অবতরণের কথা আপনি চিন্তাও করতে পারেন না। অথচ বুদ্ধি-বিবেচনার কথা হল এই যে, আপনাকে নিজের নিকটস্থ ব্যক্তিদের সংশোধনের জন্যে এমন পর্যায়ে নেমে আসতে হবে, যা এ কাজের জন্যে একান্ত আবশ্যক। এখানে এসে হয়তো আপনি এক সমস্যায় পড়ে যান। কারণ একদিকে আদর্শ প্রচারের কলা-কৌশল বজায় রাখা, অপরদিকে ব্যক্তিগত মর্যাদার প্রশ্ন। কিন্তু তবুও এ ক্ষেত্রে আপনার কাছে দ্বীনের দাবি হলো এই যে, আপনি এ জাতীয় পরিবেশে নিজেকে অন্যের সমপর্যায়ে নিয়ে আসবেন এবং সকলের সঙ্গে আন্তরিকতার সাথে কথাবার্তা বলবেন ও মেলামেশা করবেন। তাদেরকেও নিজেদের স্বাধীন মতামত প্রকাশের সুযোগ দান করবেন যদিও উচ্চ মর্যাদাবোধ আপনাকে তা করার অনুমতি দেয় না। আদর্শ প্রচারের কৌশল এটাই চায় যে, আপনি যুক্তি প্রমাণের মাধ্যমে নিজের নিকটস্থ ব্যক্তিদের মনোভাব পরিবর্তনের চেষ্টা করবেন। কিন্তু তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যাপারে যেহেতু আপনি এ ধরনের আচরণে অভ্যস্ত নন, সর্বদাই তাদের ওপর ইচ্ছায় অনিচ্ছায় আপনার মতামত চাপিয়ে আসছেন, তাই এখানেও আপনি চাইবেন যে, টু-শব্দটিও না করে নীরবে আপনার প্রাধান্যকে মেনে নিতে হবে। অথচ দ্বীনের বৃহত্তর স্বার্থের প্রশ্নে আপনার এ মনোভাব পরিহার করা অপরিহার্য। অপরের মতামত এবং ভাবাবেগের প্রতি লক্ষ্য রাখা একান্ত কর্তব্য। কিন্তু অনেকে এ কথা ভুলে গিয়ে অন্যান্য কাজকর্মের ন্যায় এ ক্ষেত্রেও এর প্রতি ভ্রুক্ষেপ করতে প্রস্তুত থাকে না।

এ কয়টা বিশেষ বিশেষ কারণেই নিজের নিকটতম পরিবেশেও প্রচারক নিজেকে ‘উপেক্ষিত আগন্তুকের’ পর্যায়ে ফেলে দেয়। এতে হয়তো আপনার মনে সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে যে, আদর্শ প্রচারের ক্ষেত্রে যদি উল্লেখিত উপদেশাবলী পালন করা হয় তাহলে অন্যান্য ব্যাপারে যথেষ্ট অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে। কারণ গৃহকর্তা বা বড় অফিসার হিসেবে মানুষের সঙ্গে আচার-ব্যবহারে চলনে-বলনে আপনাকে এ বিশেষ একটা মেজাজ গ্রহণ করতে হবে। আবার আদর্শ তথা দ্বীনের প্রচারকল্পে আপনাকে গ্রহণ করতে হবে অন্য রকম ভংগী। এ রকম দু’মুখো নীতিকে আপনি আত্মস্থ করতে পারবেন না। সে সময় আপনার আদর্শ প্রচারের ধরন কৃত্রিমতা দোষে দুষ্ট হয়ে পড়বে। অথবা অধীনস্থ বা নিজ পরিবারের লোকদের ব্যাপারে আপনি সতর্কতা অবলম্বন করতে চাচ্ছেন তা হয়ে পড়বে অন্তঃসারশূণ্য। আপনার এ জটিলতাটি বাস্তবতাভিত্তিক তাতে সন্দেহ নেই। অবশ্য কোন ব্যক্তির জীবনে দু’মুখো নীতি কার্যকরী হতে পারে না এবং আপনিও সফলতা লাভ করতে পারবেন না, কিন্তু তবুও এখানে একটা বিষয় গভীরভাবে চিন্তা করার আছে। তা হচ্ছে আপনি নিজের জীবনের যে পর্যায়ে এ ভয়ভীতি এবং বাধ্য-বাধকাতার নীতি অবলম্বন করে আছেন তা কি সত্যিই আপনার জন্যে জরুরী? এটা না হলেই কি নয়? আসলে এ ব্যাপারে আপনার পয়লা নম্বর ভুলটি হচ্ছে এখানেই। আপনি জীবনের এ অংশটিতে নিজের আসন এখানেই নির্দিষ্ট করেছেন। কিন্তু মূলতঃ আপনার এ ভূমিকা এ ক্ষেত্রেও সত্যিকার সফল বা প্রশংসনীয় কোন ভূমিকা নয়। কিন্তু এখানে অকৃতকার্যতা আপনি এ জন্যে উপলব্ধি করতে পারছেন না যে, যেহেতু যেসব লোক আপনার সংগে সংশ্লিষ্ট তারা নিজেদের বিভিন্ন প্রয়োজনের তাকিদে আপনার এ ভূমিকাকে বরদাশত করে নিতে বাধ্য হয়েছে। স্বেচ্ছায় কেউ তা করে না, বরং সব সময়ই তারা এ বাধ্যবাধকতা, এ মুরুব্বিয়ানা থেকে অব্যহতি পাওয়ার জন্যে সচেষ্ট থাকে। যখনই সুযোগ পায় তখনই এ বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়াকে নিজেদের সৌভাগ্য বলে মনে করে। লক্ষ্য করলে আপনিও তাদের এ অবস্থা অনুধাবন করতে পারবেন। কিন্তু যে পরিসরে আপনি মানুষকে সংশোধন করতে চাচ্ছেন এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তনের আশা পোষণ করছেন, সেখানে তারা এ কাজে কিছুতেই আপনার কথা শুনতে বাধ্য নয়। আপনি তাদের দ্বারা জোরজবরদস্তি কিছু করাতে চাইলেও বড় জোর এতটুকু হতে পারে যে তারা দৃশ্যতঃ আপনাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করবে কিন্তু অন্তর তাদের ‘ভেতরের মানুষটি’র কথাতেই অটল থাকবে। এ জন্যে তাদেরকে বাধ্য করার মতো কোন ক্ষমতাই আপনার নেই। সারকথা হলো, এ জাতীয় পরিবেশে কাজ করার জন্যেও আপনাকে সে সব পরামর্শকেই সম্মুখে রেখে অগ্রসর হতে হবে, যা অন্যের ক্ষেত্রে অনুসৃত হওয়ার জন্যে এ যাবত আলোচিত হয়েছে বা আরো হবে। এক কথায়, এ পরিবেশেও আপনাকে শ্রোতার মনের গতি-প্রকৃতির প্রতি লক্ষ্য রেখে কাজ করতে হবে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url