Ad

তাওহীদ ও শিরক, শিরক চার প্রকার,প্রচলিত শিরকের উদাহরণ

তাওহীদ ও শিরক

 

তাওহীদের সম্পূর্ণ বিপরীত পরিভাষা হলো শিরক  । তাওহীদ শব্দের অর্থ হলো অদ্বিতীয়তাবাদ।সাধারণ এর অর্থ করা হয় একাত্ববাদ। এ অর্থটি ত্রুটিপূর্ণ। আরবী ওয়াহিদ শব্দের অর্থ এক, আর আহাদ অর্থ অদ্বিতীয়।

 

قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ  বল যে, আল্লাহ অদ্বিতীয়। একের পর দুই, তিন ইত্যাদি সংখ্যা রয়েছে। তাই একাত্ববাদ বললে মূল মর্মটি বুঝায় না।অদ্বিতীয় মানে, যার কোনো সমকক্ষ নেই, এমনকি যার সাথে তুলনা করার মতোও কেউ নেই।

 

তাওহীদ সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেতে হলে র্শিক সম্বন্ধে সুস্পষ্ট জ্ঞান থাকতে হবে। কারণ তাওহীদ মানেই র্শিক না থাকা। তাওহীদের সবচেয়ে স্পষ্টও সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞাই হলো র্শিকমুক্ত ঈমান। যেমন আলোর সহজ সংজ্ঞা হলো অন্ধকার না থাকা। তাই শিরক সম্পর্ক বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন।

 

যারা আল্লাহকে অস্বীকার করে তারা কাফির। যারা শিরক করে তারা আল্লাহকো অস্বীকার করে না। তারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে বটে কিন্তু আল্লাহর সাথে অন্যান্য সত্তা বা শক্তিকে বিভিন্ন ভাবে শরীক করে। তাদেরকে মুশরিক বলা হয়।

 

শিরক শব্দটির অর্থ হলো শরীক করা। আল্লাহর সাথে কী কী ভাবে শরীক করা হয় তা বুঝতে পারলে শিরক সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে এবং শিরক থেকে বেচে থাকাও সহজ হবে।

 

মাওলানা মওদূদী (র) তার বিখ্যাত তাফসীর তাফহীমুল কুরআনে সূরা আনআমের ১২৮নং টীকায় শিরক সম্পর্কে যে আলোচনা করেছেনে এর সমামানের কোন আলোচনা আমি পাইনি। কুরআন মাজীদে শত শত আয়তে শিরকের কথা আছে এবং ঐসব জায়গায়ই টীকাও আছে। আমার জানা মতে সূরা আনআমের ১২৮নং টীকাতে শিরকের পূর্ণঙ্গ ব্যাখা পাওয়া যায়। অন্যান্য শত শত টীকায় কোথাও ১০% কোথাও ৫০% ব্যাখ্যা আছে।১২৮নং টাকাটি ভালোভাবে হজম করতে পারলে অন্যান্য টীকা পড়ার দরকারই হবে না। আমি সে ব্যাখাটিই এখানে পেশ করছি।

 

শিরক চার প্রকার

 

যারা আল্লাহর সাথে অন্য সত্তাকে শরীক করে তারা এ কাজটি চারভাবে করে থাকে।

 

১. আল্লাহর সত্তার (Person) সাথে শরীক করে।

 

যেমন কাউকে আল্লাহর পুত্র, কন্যা বা স্ত্রী সাব্যস্ত করে। কুরআনে আছে ঃ

 

وَقَالَتِ الْيَهُودُ عُزَيْرٌ ابْنُ اللَّهِ وَقَالَتِ النَّصَارَى الْمَسِيحُ ابْنُ اللَّهِ

 

ইহুদীরা হযরত ওযায়িরকে আল্লাহর পুত্র বলে। আর খ্রিষ্টানরা মাসীহ (আ) কে আল্লাহর পুত্র বলে। (সূরা তাওবাঃ ৩০)

 

খ্রিষ্টানরা হযরত ঈসা (আ) এর মা হযরত মারইয়াম (আ) কে আল্লাহর স্ত্রী মনে করে।

 

ফেরেশতাগণকে আল্লাহর কন্যা মনে করা হত বলে কুরআনে বহু জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে। দেব দেবীদেরকেও আল্লাহর বংশ বলে বিশ্বাস করা হয়। কতক স্বৈরশাসক নিজেদেকে স্রষ্টার বংশধর বলে দাবি করেছে। এভাবেই আল্লাহর যাতের সাথে অন্য সত্তাকে শরীক করা হয়।

 

২. আল্লাহর গুণাবলির সাথে শরীক করা।

 

যেসব গুণ একান্তেই আল্লাহর সেসব গুণ কারো মধ্যে আছে বলে বিশ্বাস করা শিরক। যেমন গায়েবী ইলম বা অদৃশ্য স¤পর্কে জ্ঞান। কারো সম্পর্কে এমন ধারণা করা যে তিনি সবকিছু জানেন দেখেন বা শুনেন এবং সব দোষ ত্র“টি থেকে মুক্ত।

 

৩.  আল্লাহর ক্ষমতায় অন্য কোনো সত্তাকে শরীক করা। যেসব ক্ষমতা শুধু আল্লাহর সেসব ক্ষমতা আর কারো মধ্যে আছে বলে বিশ্বাস করা শিরক। যেমন

 

ক. আইন দেওয়া ক্ষমতা হালাল ও হারাম বা জায়েয ও না জায়েয এর সীমা নির্ধারণ করা। মানবজীবনের জন্য বিধি বিধান রচনা করা একমাত্র আল্লাহর ইখতিয়ার। আল্লাহর দেওয়া আইন রচনার ক্ষমতা আছে কিন্তু মৌলিক আইন রচনার অধিকার আল্লাহ ছাড়া আর কারো নেই।

 

খ.অলৌকিকভাবে কারো উপকার বা ক্ষতি করা প্রয়োজন পূরণ করা, হেফাযত করা রক্ষণাবেক্ষণ করা দোআ শোনা ও কবুল করা ভাগ্য গড়া ও ভাঙা ইত্যাদি আল্লাহ ছাড়া আর কারো পক্ষে করার ক্ষমতা আছে মনে করা।

 

গ. সন্তান দান করা রোগ দেওয়া ও আরোগ্য করা রিযক দান আপদ বিপদ দেওয়া ও দূর করা ইত্যাদি শুধু আল্লাহর একক ক্ষমতা। এতে কেউ শরীক নেই।

 

৪.  আল্লাহর অধিকারে আর কাউকে শরীক করা।

 

যেমন রুকু ও সিজদা করা হাত বেধে নত হয়ে ভক্তি শ্রদ্ধা দেখানো পশু কুরবানী করা বিপদ আপদে কাতরভাবে দোআ করা দয়া ও অনুগ্রহ পাওয়ার আশায় কোনো কিছু দান করা ইত্যাদি একমাত্র আল্লাহর প্রাপ্য বা হক।

 

প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে কারো অসন্তুষ্টির ভয় করা প্রয়োজন পূরণের ও বিপদ দূর করার জন্য দোআ করা নিঃশর্ত আনুগত্য করা সত্য ও অসত্যের মাপকাঠি গণ্য করা ইত্যাদি শুধু আল্লাহর হক। এসব হকের কোনোটি পাওয়ার যোগ্যতা অন্য কোনো সত্তার আছে বলে মনে করা শিরক। কুরআন মাজীদে বারবার ঘোষণা করা হয়েছে যে আল্লাহ তায়ালা শিরকের গুনাহ মাফ করবেন না। উপর্যুক্ত ৪ প্রকার শিরকের ১নং শিরক মুসলমারদের মধ্যে নেই। কিন্তু বাকি সব রকমের শিরকই মুসলমানদের মধ্যেও ব্যাপকভাবে পাওয়া যায়। এর প্রধান কারণ হলো শিরক সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকা।

 

প্রচলিত শিরকের উদাহরণ

 

১. আমাদের দেশে মানুষের মনগড়া আইন চালু আছে। আল্লাহর আইন কায়েমের চেষ্টা না করলে বুঝা গেল যে মানুষের তৈরি চালু আইনকে মন থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। এসব আইন বৈধ মনে করা যে শিরক তা অনেকেই বুঝে না। যারা এসব অবৈধ আইন উৎখাত করে আল্লাহর আইন চালু করার চেষ্টা করে তারা শিরক থেকে বেচে গেল।

 

২. রিযকের মালিক একমাত্র আল্লাহ। যে পেশাই গ্রহণ করা হোক ঐ পেশা রাযযাক নয়। ঐ পেশা নষ্ট হলেও আল্লাহ অন্য উপায়ে রিযক দিতে সক্ষম।

 

কোন স্কুল, কলেজ বা মাদরাসার শিক্ষক ইসলামী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। ঐ সব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে রিযক বন্ধ করার ভয় দেখিয়ে দীনের কাজ থেকে বিরত রাখতে পারে। যদি কেউ চাকরি চলে যাবার ভয়ে ইকামাতে দীনের কাজ বন্ধ করে দেয় তাহলে বুঝা গেল যে সে আল্লাহকে একমাত্র রাযযাক মনে করে না। সে চাকরিকেও রিযকদাতা হিসেবে আল্লাহর সাথে শরীক মনে করে। এভাবেই শিরক ঈমানকে দুর্বল করে। ঈমান শিরকমুক্ত না হলে মযবুত হতে পারে না। যে চাকরি বাচানোর জন্য আল্লাহর পথে জিহাদ করা বন্ধ করল আল্লাহর সাথে তার ঈমানের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল।

 

কয়েক বছর আগে খুলনা থেকে এক যুবক আলেম আমার সাথে দেখা করলেন। বললেন আমি খুলনায় এক মসজিদের ইমাম ছিলাম। আমি প্রকাশ্যে জামায়াতে ইসলামীর কর্মী হিসেবে দয়িত্ব পালন করছিলাম। মসজিদ কমিটিতে চরমোনাইর পীরের মুরীদদের সংখ্যই বেশি। তারা আমাকে জানালেন যে জামায়াতে ইসলামী ত্যাগ না করলে আমাকে ইমামতী ত্যাগ করতে হবে। আমি চাকরি ছেড়ে চলে এসেছি। কারণ আমি বুঝে শুনে জামায়াতে কাজ করছিলাম।

 

যদি তিনি চাকরিতে বহাল থাকার জন্য জামায়াত ত্যাগ করতেন তাহলে এটা শিরক হতো এবং আল্লাহর সাথে তার ঈমানের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যেত। তিনি শিরক থেকে মুক্ত ছিলেন বলেই সাহস করে চাকরি ছেড়ে দিলেন।

 

এর বিপরীত উদাহরণই বেশি পাওয়া যায়। কুমিল্লা জেলার এক দাখিল মাদরাসার দু জন তরুণ শিক্ষক আমার সাথে দেখা করতে এলো। পরিচয় দিতে গিয়ে বলল আমরা দুজনই ছাত্রজীবনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাথী ছিলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা যেখানে শিক্ষকতা করছ ওখানে জামায়াতে ইসলামীর সংগঠন নেই? জওয়াবে বলল, অবশ্যই আছে। বললাম, তাহলে জামায়াতের সাথে কী সম্পর্ক তা তো বললে না। বলল, মাদ্রাসার সুপার এত জামায়াতবিরোধী যে, আমরা জামায়াত করছি জানলে মাদ্রাসা থেকে বের করে দেবে।

 

আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কি আল্লাহকে রায্যাক মনে কর না? বিস্মিত হয়ে এ কথা কেন বললাম তা জানতে চাইলে। বললাম, তোমরা ঐ মাদ্রসাকেও চাকরী বাচানোর জন্য দীনের দায়িত্ব অবহেলা করছে। এতে ঈমানের দুর্বলতাই প্রকাশ পেল। এতে আল্লাহর সাথে ঈমানী সম্পর্কটাই ছিন্ন হয়ে গেল কি না তোমরা ভেবে দেখ।

 

৩. আমাদের ধেশে অনেক লোক আজমীরে হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতি (রা:) এবং বাগদাদে হযরত আবদুল কাদির জিলানী (রা:) এর মাযারে গিয়ে তাদের নিকট সন্তানের জন্য, বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য, রোগ দূর করে দেওয়ার জন্য এবং আরও বিভিন্ন রকম মকসূদ হাসিলের উদ্দেশ্যে দোয়া করে। এসব দোয়া শুধু আল্লাহরই দরবারেই করা প্রয়োজন। বুজুর্গদের মাযারে গিয়ে দোয়া করা সুস্পষ্ট র্শিক। ওখানে গিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করাও সঠিক নয়। আল্লাহর কাছে চাওয়ার জন্য সেখানে যাওয়া অর্থহীন।

 

মাযার ও কবরের সাথে সম্পর্তিত বহু রকমের র্শিক ব্যাপকভাবে জনগণের মধ্যে চালু রয়েছে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url