Ad

আমাদের কর্ম এবং তার পরিণাম বা ফল।

 

পরিণাম ফল

সাহিত্য অগ্রভাগে চলে, জনমত চলে তাহার পশ্চাতে। অবশেষে সামাজিক চরিত্র, নিয়মনীতি, রাষ্ট্রের আইন-কানুন তাহার নিকট আত্মসমর্পণ করে। যেখানে ক্রমাগত দেড় শত বৎসর যাবত দর্শন, ইতিহাস, নৈতিকতা, বিজ্ঞান, উপন্যাস, নাটক, শিল্পকলা প্রভৃতি মানসিক বিপ্লব সৃষ্টিকারী উপায়-উপাদানগুলি সম্মিলিত শক্তিতে একই প্রকারের দৃষ্টিভঙ্গী ও চিন্তাধারা মানুষের মনে অনুপ্রবিষ্ট করিতে থাকে, সে ওখানে সমাজের এইরূপ চিন্তাধারায় প্রভাবান্বিত না হওয়া এক অতি অসম্ভব ব্যাপার। অতপর যেখানে সরকার ও যাবতীয় সামাজিক ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়, সেখানে ইহাও সম্ভব নহে যে, জনমতের পরিবর্তনের সহিত আইনেরও পরিবর্তন হইবে না।

শিল্প বিপ্লব ও তাহার প্রতিক্রিয়া

অবলীলাক্রমে অন্যান্য তামাদ্দুনিক উপকরণ ঠিক সময়োপযোগী হইয়া পড়িয়াছিল। এই সময়েই শিল্প বিপ্লব (Industrial Revolution) সংঘটিত হইয়াছিল। ইহার দ্বারা অর্থনৈতিক জীবনে যে সমস্ত পরিবর্তন ঘটিয়াছিল এবং সাংস্কৃতিক জীবনে তাহার যে সকল প্রভাব পরিস্ফুট হইয়াছিল, তাহা ঘটনা প্রবাহকে সেই দিকেই পরিচালিত করিতেছিল, যেদিকে বিপ্লবী সাহিত্যগুলি পরিচালিত করিতে চাহিয়াছিল। ব্যক্তি স্বাধীনতার যে ধারণার উপরে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, যান্ত্রিক আবিস্কার ও ব্যাপক উৎপাদনের (Mass Production) সম্ভাবনা তাহাকে অসাধারণ শক্তি দান করিয়াছিল। ধনিক শ্রেণী বড় বড় শিল্প ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান কায়েম করিল। শিল্প ব্যবসায়ের নূতন নূতন কেন্দ্রগুলি বিরাট বিরাট নগরে পরিণত হইল। পল্লী অঞ্চল হইতে লক্ষ লক্ষ নর-নারীকে শহরে টানিয়া আনা হইল। জীবিকা আশাতিরিক্ত মহার্ঘ হইয়া পড়িল। বাসস্থান, খাদ্য, বস্ত্র ও জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য দৈনন্দিন আবশ্যকীয় দ্রব্যাদি অগ্নিমূল্য হইয়া পড়িল। কিছুটা সাংস্কৃতিক উন্নতির কারণে এবং কিছুটা পুঁজিপতিদের চেষ্টায় জীবনের আবশ্যকীয় দ্রব্যাদির মধ্যে অসংখ্য বিলাস-সামগ্রী স্থানলাভ করিল। কিন্তু পুজিপুতিগণ দৈনন্দিন জীবনে যে সমস্ত আরাম, আনন্দ উপভোগ ও বিলাসভূষণের সৃষ্টি করিয়াছিল, তাহা লাভ করিবার উপায়-উপকরণ যাহাতে সকলে সমভাবে ভোগ করিতে পারে, ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সেই পর্যায়ে ধনবণ্টন করা করা হইল না। পুঁজিপতিদের পল্লী অঞ্চল হইতে জনসাধারণকে শহরে টানিয়া আনিবার পর তাহাদের জীবন যাপনের অত্যাবশ্যক সামগ্রী, বাসস্থান, খাদ্য, বস্ত্র প্রভৃতির সংস্থান সহজেই হইতে পারিত। ইহার ফল এই হইল যে, স্ত্রী স্বামীর এবং সন্তান-সন্ততি  পিতার গলগ্রহ হইয়া পড়িল। জ্ঞাতি কুটুম্ব ও স্বজনবর্গের বোঝা বহন করা তো দূরের কথা, নিজকে নিজেরই সামাল দেওয়া সুকঠিন হইয়া পড়িল। আর্থিক অবস্থা প্রত্যেক ব্যক্তিকে উপার্জন করিতে বাধ্য করিল। কুমারী, বিবাহিতা নারী, বিধবা প্রভৃতি সকল শ্রেণীর নারীকে জীবিকার্জনের জন্য গৃহ হইতে বাহির হইতে হইল। অতঃপর যখন নারী পুরুষের একত্রে মেলামেশার সুযোগ বাড়িয়া গেল এবং উহার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম ফল দেখা দিল, তখন স্বাধীনতার ধারণা ও নূতন চরিত্র দর্শন পিতা-কন্যা, ভ্রাতা-ভগ্নি, স্বামি-স্ত্রী সকলকে সান্তনা দান করিয়া বলিল, ‘অধীর হইও না, যাহা হইতেছে বেশ হইতেছে! ইহা অধপতন নহে, প্রকৃতপক্ষে ইহাই উন্নতি ও মুক্তি (Emancipation)। এই যে অতল গহবরে পুঁজিপতিগণ তোমাদিগকে নিক্ষেপ করিতেছে, ইহা নরককুণ্ড নহে, স্বর্গ-পরম স্বর্গ।’

ধনতান্ত্রিক ব্যক্তিস্বার্থ

অন্যান্য বিষয় এই পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রহিল না। ব্যক্তি স্বাধীনতার এক প্রকার ধারণার উপরে যে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হইল, তাহা ব্যক্তিকে সকল প্রকার সম্ভাব্য উপায়ে ধনার্জনের সীমা শর্তহীন নিরঙ্কুশ অধিকার দান করিল। যে কোন উপায়েই ধন অর্জিত হউক, এমন কি কাহারও ধনার্জনের ফলে যতজনেরই ধ্বংস সাধন হউক না কেন-নূতন চরিত্রদর্শন তাহাকে বৈধ ও পবিত্র বলিয়া মনে করিল। এইরূপে যাবতীয় সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হইল যে, সমষ্টির বিপক্ষে সকল দিক দিয়া ব্যক্তিকে সমর্থন করা হইল। পক্ষান্তরে ব্যষ্টির ব্যক্তিগত স্বার্থের বিপক্ষে সমষ্টির অধিকার রক্ষার কোন উপায় রহিল না। স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিবর্গের জন্য সমাজকে ধ্বংস করিবার যাবতীয় পথ উন্মুক্ত হইল। তাহারা যাবতীয় মানবীয় দুর্বলতার সুযোগে স্বীয় স্বার্থসিদ্ধ করিবার নব নব পন্থা অবলম্বন করিতে আরম্ভ করিল। এক ব্যক্তির আবির্ভাব হইতেছে এবং সে স্বীয় পকেট পূর্ণ করিবার জন্য অপরকে মদ্যপানের কুকার্যে লিপ্ত করিতেছে। এই প্লেগ-মুষিক হইতে সমাজকে রক্ষা করিবার জন্য কেহই অগ্রসর হইতেছে না। অপর এক ব্যক্তির আবির্ভাব হইতেছে এবং সে সুদের জাল বিস্তার করিয়া দিতেছে। এমন কেহ নাই যে, মানুষকে এই রক্ত শোষক জোঁকের কবল হইতে রক্ষা করে। উপরন্তু যাবতীয় আইনকানুন এই রক্ত শোষকের স্বার্থ সংরক্ষিত করিতেছে, যেন কেহই তাহার কবল হইতে এক বিন্দু রক্তও নিরাপদে রাখিতে না পারে। তৃতীয় এক ব্যক্তির আবির্ভাব হইতেছে, সে জুয়ার এক অদ্ভূত পন্থা আবিস্কার করিতেছে। ইহার প্রসার এত ব্যাপক হইতেছে যে, শিল্প ব্যবসায়ের কোন বিভাগই জুয়ার প্রভাব মুক্ত হইতেছে না। মানুষের অর্থনৈতিক আয়ুকে এই দাহনকারী অগ্নি হইতে রক্ষা করিবার কেহই নাই। যে যুগে মানুষের অতি মারাত্মক দুর্বলতা যৌন উন্মাদনায় ইন্ধন সংযোগ করত প্রভুত স্বার্থসিদ্ধ করা সম্ভব হইত সেই যুগে সেই ব্যক্তিগত ঔদ্ধত্য, বিদ্রোহ ও শত্রুতার অপবিত্র যুগে এবম্বিধ মানবীয় দুর্বলতার প্রতি স্বার্থান্ধ ব্যক্তিবর্গের দৃষ্টি আকৃষ্ট না হওয়া এক অসম্ভব ব্যাপার ছিল। বস্তুত এই যৌন-উচ্ছৃঙ্খলতার দ্বারা যথাসম্ভব কার্যোদ্ধার করা হইয়াছে। রঙ্গমঞ্চ, নৃত্যশালা ও চলচ্চিত্রের নির্মাণকেন্দ্রগুলিতে যাবতীয় কার্যকলাপ সুন্দরী নারীকে কেন্দ্র করিয়াই চলিত। এই সকল কার্যে নারীর অংশগ্রহন অনিবার্য ছিল। নারীকে অধিকতর নগ্ন আকারে এবং কামোদ্দীপক মূর্তিতে জনসাধারণের সম্মুখে উপস্থিত করা হইত। ইহা দ্বারা লোকের যৌন তৃষ্ণাকে বর্ধিত করিয়া তাহাদের অর্থ লুট করা হইত। কিছু সংখ্যক লোক নারীকে ভাড়া খাটাইতে শুরু করিল এবং বেশ্যাবৃত্তির উন্নতি সাধন করিয়া তাহাকে একটি সুসংগঠিত আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ে পরিণত করিল। আবার কতিপয় লোক সৌন্দর্য ও বিলাসিতার নব নব উপকরণ আবিস্কার করত তাহার দ্বারা নারীদের সৌন্দর্য প্রদর্শনের জন্মগত অনুভূতিকে বাড়াইয়া নিয়া তাহাদিগকে উন্নত করিয়া তোলা হইল এবং স্বার্থান্বেষী ব্যবসায়ীর দল ইহার দ্বারা প্রভুত অর্থ উপার্জন করিতে লাগিল। কেহ কেহ আবার যৌন উত্তেজক নব নব বেশভূষা ও নগ্নতার ফ্যাশান আবিস্কার করত সুন্দরী নারীকে উহা পরিধান করাইয়া সমাজে বিচরণ করিতে উদ্বুদ্ধ করিল এবং নব্য যুবকের দল সতৃষ্ণ নয়ন ও মন লইয়া ইহাদের দিকে ভীড় জমাইতে লাগিল। তরুণীর দল নবাবিষ্কৃত উলঙ্গ বাহার বেশভূষার প্রতি আকৃষ্ট হইয়া পড়িল এবং নুতন পোশাকের বাজারও সরগরম হইয়া উঠিল। কতিপয় লোক সুযোগ বুঝিয়া নগ্ন ছবি ও অশ্লীল সাহিত্যের প্রচার শুরু করিল এবং এইভাবে জনসাধারণকে কুষ্ঠব্যাধিতে সংক্রমিত করিয়া বেশ দু’পয়সা রোজগার করিতে লাগিল। ক্রমশ অবস্থা এতদুর গড়াইল যে, ব্যবসা-বাণিজ্যের কোন বিভাগও যৌন উন্মাদনার উপায়-উপকরণ হইতে মুক্ত রহিল না। যে কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনাদির প্রতি লক্ষ্য করুন, দেখিতে পাইবেন যে, নারীর নগ্ন অথবা অর্ধনগ্ন প্রতিকৃতি ব্যতিরেকে কোন বিজ্ঞপ্তি একেবারেই মূল্যহীন। হোটেল, রেস্তোরাঁ, দোকানের শো-রুম বা প্রদর্শনী কক্ষ প্রভৃতিতে নারীমূর্তি এমনভাবে রক্ষিত হইয়াছে, যেন পুরুষ তদ্দিকেই আকৃষ্ট হয়। এহেন পরিস্থিতিতে অসহায় হতভাগ্য জনসাধারণের স্বার্থ রক্ষার একটিমাত্র উপায় এই ছিল যে, নিজেদের নৈতিক মনোবল দ্বারা এই সমস্ত আক্রমণ প্রতিহত করিবে এবং যৌন উন্মাদনার কবল হইতে আত্মরক্ষা করিবে। কিন্তু ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা এমন দুর্বল বুনিয়াদের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল যে, তাহার আক্রমণকে প্রতিহত করা যাইতে পারে। তাহাদের নিকট একটি পরিপূর্ণ জীবন দর্শন ও শক্তিশালী শয়তানী বাহিনী তথা সাহিত্য ছিল, যাহা সঙ্গে সঙ্গে নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে পরাস্ত ও পরাভুত করিয়া দিত। হত্যাকারীর কৃতিত্ব এই যে, সে বলির পশুকে স্বেচ্ছায় সন্তুষ্ট চিত্তে বলির জন্য প্রস্তুত করিয়া লয়।

গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা

এইখানেই বিপদের সমাপ্তি হয় নাই। উপরন্তু এই স্বাধীনতার ধারণা পাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জন্মদান করিল এবং তাহা এই ধরনের নৈতিক বিপ্লবকে ষোলকলায় পূর্ণ করিবার এক শক্তিশালী অস্ত্রে পরিণত হইল।

নতুন গনতন্ত্রের মূলনীতি এই ছিল যে, মানুষ স্বয়ং তাহার শাসক হইবে এবং নিজেদের জন্য শাসন-সংবিধান ও আইন-কানুন রচনা করিবে। যেমন ইচ্ছা তেমন আইন তাহারা রচনা করিবে এবং ইচ্ছামত কোন আইন রহিত বা পরিবর্তন করিবে। তাহাদের উপরে প্রাধান্য বিস্তারকারী মানবীয় দুর্বলতামুক্ত কোন ঊর্ধ্বতন শক্তি বা কর্তৃপক্ষ নাই, যাহার পথনির্দেশ নত মস্তকে মানিয়া লইয়া মানুষ ভ্রান্ত পথ হইতে নিজেকে বাঁচাইতে পারে। তাহাদের নিকটে চিরশাশ্বত মানবীয় ক্ষমতার বহির্ভূত অপরিবর্তনীয় কোন বুনিয়াদী আইন-কানুন ছিল না। মানবীয় কুপ্রবৃত্তির তাড়নায় পরিবর্তিত হয় না, এমন অচল-অটল কোন কষ্টিপাথর তাহাদের নিকট ছিল না, যাহা দ্বারা তাহারা সত্য-অসত্য নির্ণয় করিতে পারে। এইরূপে গনতন্ত্রের নূতন দৃষ্টিভঙ্গি মানুষকে পূর্ণ স্বয়ংশাসক (Autonomous) এবং দায়িত্বহীন করিয়া দিল। তাহারা নিজেরাই নিজেদের শাসক হইল এবং জনমতকেই প্রতিটি আইনের উৎস হিসাবে গ্রহণ করিল।

প্রকাশ থাকে যে, যেখানে সামাজিক জীবনে যাবতীয় আইন-কানুন জনমতের অধীন হয় এবং যেখানে শাসন কর্তৃপক্ষ এই নতুন গণতন্ত্রখোদার দাস হইয়া পড়ে, সেখানে আইন-কানুন ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সমাজকে নৈতিক বিশৃঙ্খলা হইতে রক্ষা করিতে পারেই না, বরং শেষ পর্যন্ত উহার ধ্বংস সাধনের সহায়ক হইয়া পড়ে। জনমতের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আইনেরও পরিবর্তন হইতে থাকে। জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গির যেরূপ পরিবর্তন হইতে থাকিবে, আইন-কানুনের মূলনীতি ও বন্ধন অনুরূপভাবে গড়িতে থাকিবে। ভোটের আধিক্য যেদিকে হইবে, তাহাই সত্য এবং কল্যাণ নির্ণয়ের কষ্টিপাথর হইবে। কোন একটি প্রস্তাব, তাহা যতই অশুভ ও অসঙ্গতই হউক না কেন, যদি শতকরা একান্নজনের সমর্থন লাভ করিতে পারে, তাহা হইলে সে প্রস্তাবকে আইনে পরিণত করিতে কোন বাধাই থাকিবে না। ইহার এক নিতান্ত বীভৎস ও ঘৃণার্হ দৃষ্টান্ত জার্মানির নাৎসীপূর্ব যুগে পাওয়া যায়। ডাঃ ম্যাগনাস হারশফিল্ড (Dr. Magnus Herschfield) নামক জনৈক জার্মান দার্শনিক বিশ্বজনীন যৌন সংস্কার সভার (World League of Sexual Reform) সভাপতি ছিলেন। তিনি ছয় বৎসর যাবত লুত জাতির কুকার্যের সমর্থনে শক্তিশালী প্রচারকার্য চালান। অবশেষে গনতন্ত্রখোদা এই গতি অবৈধ কার্যকে ‘হালাল’ বা বৈধ বলিয়া ঘোষণা করিতে সম্মত হইল এবং জার্মান পার্লামেন্ট বিপুল ভোটাধিক্যে এই সিদ্ধান্ত করিল যে, উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে উক্ত কার্য সম্পাদিত হইলে তাহা আর অবৈধ থাকিবে না। ইহা স্থিরীকৃত হইল যে, যাহার প্রতি উক্ত ক্রিয়া সম্পন্ন করা হইত সে যদি অপ্রাপ্ত বয়স্ক হয়, তাহা হইলে তাহার অভিভাবক তাহার পক্ষে রায় দান করিবে।

এই গণতন্ত্র খোদার দাসত্ব পালনে আইনকে কিঞ্চিৎ ধীরগতি দেখা যায়, ইহার আদেশাবলী প্রতিপালিত হয় বটে, কিন্তু তাহা অলসতা ও ঔদাসীন্যের সহিত। পরিপূর্ণ দাসত্ব পালনে এই যে ত্রুটি-বিচ্যুতি রহিয়া যায়, রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার সকল অংশ মিলিয়া তাহা পরিপূর্ণ করিয়া দেয়। যাহারা এই সকল গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করে, তাহারা আইন রচনার পূর্বেই তাহাদের চতুষ্পার্শ্বস্থ সাহিত্য, নৈতিক দর্শন এবং জনসাধারণের ভাবপ্রবণতার প্রভাব স্বীকার করিয়া লয়। যে সকল নৈতিক উচ্ছৃঙ্খলতা জনসাধারণ্যে প্রচলিত হইয়া পড়ে, শাসন কার্য পরিচালকদের অনুগ্রহে তাহার প্রতিটি সরকারী পর্যায়ে স্বীকৃত ও গৃহীত হয়। যে সকল বিষয় তদবধি নিষিদ্ধ থাকে, পুলিশ ও বিচারালয় সেই সকল বিষয়ে আইনকে কার্যকরী করিতে বিরত থাকে। এইরূপ নিষিদ্ধ কার্যগুলিও বৈধ বলিয়া পরিগণীত হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ গর্ভনিপাতের বিষয়ই ধরা যাক। ইহা পাশ্চাত্য আইনে এখনও পর্যন্ত নিষিদ্ধ আছে। কিন্তু এমন দেশ নাই, যেখানে ইহা প্রকাশ্যে এবং অধিক পরিমাণে করা হইতেছে না। ইংল্যান্ডে প্রতি বৎসর আনুমানিক নব্বই সহস্র গর্ভনিপাত করা হয়। বিবাহিতা নারীদের মধ্যে শতকরা পঁচিশজন এমনও আছে, যাহারা হয় নিজেরাই গর্ভনিপাত করে কিংবা এই ব্যাপারে কোন বিশেষজ্ঞের সাহায্য গ্রহণ করে। কোন কোন স্থানে গর্ভনিপাতের যথারীতি ক্লাব স্থাপিত আছে। অভিজাত মহিলাগণ তথায় সাপ্তাহিক ফিস দিয়া থাকেন এবং প্রয়োজনানুসারে গর্ভনিপাত বিশেষজ্ঞের পরিচর্যা লাভ করিয়া থাকেন। লন্ডনে এইরূপ বহু নার্সিংহোম আছে যেখানে গর্ভনিপাতের রোগিণীদের চিকিৎসা হয়।( অধ্যাপক জুড, তাঁহার Guide to Modern weekedness গ্রন্থে এতদ্বিষয়ে বিস্তৃত বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। গ্রন্থখানি বেশ কয়েক বছর পূর্বে প্রকাশিত হইয়াছে)। এতদসত্ত্বেও ইংল্যান্ডের আইন গ্রন্থে এখনও গর্ভনিপাত অপরাধজনক বলিয়া লিপিবদ্ধ আছে।

মূলতত্ত্ব ও প্রমাণাদি

এখন আমি বিস্তারিত বর্ণনা করিতে চাই যে, আধুনিক নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী, ধনতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শাসন-এই তিনটি উপাদানের একত্র সমাবেশে সামাজিক চরিত্র এবং নারী পুরুষের যৌন সম্পর্ক কতখানি প্রভাবান্বিত করিতেছে এবং কি পরিমাণ পরিস্ফুট হইতেছে। যেহেতু আমি এ যাবত অধিক পরিমাণে ফরাসী দেশেরই উল্লেখ করিয়াছি- যেখান হইতে এ আন্দোলন শুরু হইয়াছিল-সেইজন্য আমি সর্বপ্রথমে ফরাসী দেশকেই প্রমাণ হিসাবে উপস্থাপিত করিব। (ফরাসীর সমাজতত্ত্ববিদ Paul Bureau – এর গ্রন্থ Towards Moral bankruptcy দ্রষ্টব্য। ইহা ১৯২৫ সনে প্রকাশিত হয়।)

নৈতিক অনুভুতির বিলোপ সাধন

পূর্বতন অধ্যায়ে যে সকল দৃষ্টিভঙ্গীর বর্ণনা করা হইয়াছে, তাহার প্রচারণার প্রাথমিক ফল এই হইল যে, যৌন আচরন সম্পর্কে মানুষের নৈতিক অনুভূতি বিকল হইয়া পড়িল। লজ্জা, শ্লীলতা, ঘৃণা, অবজ্ঞা প্রভৃতি দিন দিন লোপ পাইতে লাগিল। বিবাহ ও ব্যভিচারের পার্থক্য-জ্ঞান হৃদয় হইতে মুছিয়া গেল। অবশেষে ব্যভিচার এমন এক নির্দোষ বস্তুতে পরিণত হইল যে, তাহা ঘৃণাভরে গোপন করার প্রয়োজন বোধই রহিল না।

উনবিংশ  শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত ফরাসী জনসাধারণের নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর শুধু এতটুকু পরিবর্তন হইয়াছিল যে, পুরুষের পক্ষে ব্যভিচার এক অসাধারণ প্রাকৃতিক বিষয় বলিয়া মনে করা হইত। তরুণ বয়স্ক পুত্রগণ যৌনব্যাধিতে আক্রান্ত না হইলে কিংবা তাহাদের বিচারালয়ে প্রেরিত হইবার আশংকা না থাকিলে, পিতা-মাতা সন্তুষ্ট চিত্তে তাহাদের যৌন স্বেচ্ছাচারিতার প্রশ্রয় দান করিত। উপরন্তু বৈষয়িক দিক দিয়া লাভবান হইলে তাহারা পরম পরিতুষ্ট হইত। তাহাদের এইরূপ ধারণা ছিল যে, বিবাহ ব্যতিরেকে নারী-পুরুষের যৌন-সম্পর্ক দুষনীয় নহে। এমন দৃষ্টান্তও পাওয়া যায় যে, পিতা-মাতা তরুণ বয়স্ক পুত্রদিগকে প্রভাবশালী অথবা ধনাঢ্য নারীর সহিত সম্পর্ক স্থাপন করত ভবিষ্যত উজ্জ্বল করিতে উদ্বুদ্ধ করিত। কিন্তু তখন পুরুষদের সম্পর্কে তাহাদের দৃষ্টিভঙ্গী পরবর্তীকালীন দৃষ্টিভঙ্গী হইতে বিভিন্ন ছিল। নারীর সতীত্বকে মূল্যবান মনে করা হইত। যে পিতা-মাতা স্বীয় পুত্রদের যৌন-স্বেচ্ছাচারিতাকে যৌবনোচ্ছাস মনে করিয়া তাহাকে উপেক্ষা করিত, তাহারাই আবার আপন কন্যার চরিত্রে কোন কলুষ-কালিমা সহ্য করিতে পারিত না। অসৎ পুরুষকে নির্দোষ মনে করা হইলেও অসৎ নারীকে নির্দোষ মনে করা হইত না। ব্যবসায়ী বারাঙ্গণার নামোচ্চারণে ঘৃণাভরে ভ্রূকুঞ্চিত হইলেও তাহার শয্যাসঙ্গী পুরুষের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করা হইত না। অনুরূপভাবে দাম্পত্য জীবনেও নারী পুরুষের নৈতিক দায়িত্ব একই রূপ ছিল না। স্বামীর চরিত্রহীনতা সহ্য করা হইলেও স্ত্রীর চরিত্রহীনতা মারাত্মক দূষণীয় ছিল।

বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভকালে এই অবস্থার পরিবর্তন হইল। নারী স্বাধীনতার আন্দোলন নারী-পুরুষের নৈতিক সাম্যের যে বাঁশী বাজাইল, তাহার ফল এই হইল যে, পুরুষের কুকার্যের ন্যায় নারীর কুকার্যকেও নির্দোষ মনে করা হইল। বিবাহ ব্যতিরেকে কোন পুরুষের সহিত যৌন-সম্পর্ক স্থাপন করিলে নারীর আভজাত্য বা মান-সম্ভ্রমে আঘাত লাগিতে পারে, এই ধারনাও পরিবর্তিত হইল। Paul Bureau বলেনঃ

শুধু বড় বড় শহরেই নহে, ফ্রান্সের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শহর ও পল্লীতেও নব্য যুবকদের দল এই নীতিকে মানিয়া লইয়াছে যে, তাহারা যখন নিজেরাই জিতেন্দ্রিয় নহে, তখন ঘটকের নিকটে সতী বা কুমারী নারীর দাবী করিবার তাহাদের অধিকার নাই। বারগুন্ডী, বুন ও অন্যান্য অঞ্চলে ইহা এক সাধারন ব্যপার যে, বিবাহের পূর্বে বালিকা বহু বান্ধবের সাহচর্য লাভ করে এবং বিবাহের সময় তাহার বিগত জীবনের ঘটনাবলী ঘটকের নিকট অপ্রকাশ রাখার প্রয়োজন বোধ করে না। খেলাধুলা অথবা জীবিকার্জন সম্পর্কে আলোচনার ন্যায় পরস্পর পরস্পরের অকাতরে পর পুরুষের সহিত অবৈধ সাহচর্যের বিষয় আলোচনা করে। বিবাহকালে পাত্র যে শুধু পাত্রীর বিগত জীবন সম্পর্কে অবহিত হয় তাহা নহে, বরং যে সমস্ত বন্ধুবর্গ তখন পর্যন্ত তাহার দেহ সম্ভারকে উপভোগ করিয়াছে, তাহাও তাহার গোচরীভূত হয়। এমতাবস্থায় পাত্র প্রবর বিশেষ সচেষ্ট থাকেন, যাহাতে কেহ সন্দেহ করিতে না পারে যে, পাত্রীর এতাদৃশ কার্যকলাপের প্রতি তাহার কোনরূপ আপত্তি আছে।     -উক্ত গ্রন্থের, পৃ.৯৪

তিনি আরও বলেনঃ

ফ্রান্সের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজের শিক্ষিতা মেয়েদিগকে অফিস অথবা ব্যবসায় প্রতিস্থানে চাকুরী করিতে বহুল পরিমাণে দেখা যায়। তাহারা ভদ্র সমাজে অবাধ মেলামেশাও করে এবং সকল কার্য মোটেই নীতিবিরুদ্ধ বিবেচিত হয় না। অতঃপর এই সকল মেয়েদের কেহ কোন যুবকের প্রতি আকৃষ্ট হইয়া তাহার সহিত বসবাস করিতে থাকিলে তাহাদের মধ্যে বিবাহ একেবারেই অনাবশ্যক মনে করা হ্য়। তাহারা বিবাহ ব্যতিরেকেই একত্রে বসবাস করাকে শ্রেয় মনে করে। অবশ্য উভয়ের মনের সাধ পরিপূর্ণ হইবার পর একের অপর হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া অন্যত্র কোথাও প্রেম নিবেদন করিবার পূর্ণ অধিকার তাহাদের থাকে। তাহাদের এহেন সম্পর্ক সম্বন্ধ সমাজের নিকট অজ্ঞাত থাকে না। তাহারা উভয়ে মিলিয়া ভদ্র মহলে যাতায়াত করে। তাহাদের এইরূপ পারস্পরিক সম্পর্ককেও তাহারা গোপন করে না এবং অন্য কেহই তাহাদের এই জীবন যাপন প্রণালীতে মন্দ কোন কিছু দেখিতে পায় না। যাহারা কারখানায় কাজ করে, তাহাদের মধ্যেই প্রথমত এই আচরণ দেখা যায়। পরে ইহা অত্যন্ত দুষনীয় মনে করা হইত। কিন্তু ইহা সম্ভ্রান্ত পরিবারের মধ্যে এক সাধারণ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হইয়া পড়িয়াছে। সামাজিক জীবনে বিবাহের যে মর্যাদা ছিল, এই ধরনের জীবন যাপন এখন সেই মর্যাদা লাভ করিয়াছে।                      -উক্ত গ্রন্থের, পৃ.৯৪-৯৬

এইভাবে রক্ষিতাকেও এখন যথারীতি স্বীকার করিয়া লওয়া হইয়াছে। মশিয়ে বারথেলেম (M.Berthelemy) প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনশাস্ত্রের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি বলেন যে, ‘ক্রমশ রক্ষিতা নারী বিবাহিতা স্ত্রীর ন্যায় আইনগত মর্যাদা লাভ করিতেছে। পার্লামেন্টে তাহাদের বিষয়ে আলোচনা শুরু হইয়াছে। এখন সরকার তাহাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করিতে আরম্ভ করিয়াছে। একজন সৈনিকের বিবাহিতা স্ত্রীর জন্য যে ভাতা বরাদ্ধ করা হয় উক্ত সৈনিকের মৃত্যুর পরও তাহার স্ত্রীর ন্যায় অনুরূপ বৃত্তি তাহার রক্ষিতাও ভোগ করে।’

ফরাসী নীতিবিজ্ঞান অনুযায়ী ব্যভিচারকে নির্দোষ মনে করিবার কারণ নিম্নের ঘটনা হইতে নির্ণয় করা যায়ঃ

খৃ.১৯১৮ সালে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষয়িত্রী অবিবাহিতা হইয়াও গর্ভধারণ করে। শিক্ষা বিভাগে কিছু সংখ্যক পুরাতনপন্থী লোক ছিল, তাহারা এতদ্বিষয়ে কিছু হৈ চৈ শুরু করিল। ইহাতে সম্ভ্রান্ত লোকদের  একটি প্রতিনিধিদল শিক্ষামন্ত্রী সমীপে গমন করত নিম্নের যুক্তি প্রমাণাদি এমনভাবে উপস্থাপিত করিল যে, উক্ত শিক্ষয়িত্রীর বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া হইল।

১.কাহারও ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করিবার অন্যের কি অধিকার আছে?

২.তাহার অপরাধই বা এমন কি হইয়াছে?

৩.বিবাহ ব্যতিরেকে সন্তানের মাতা হওয়া কি অধিকতর গণতান্ত্রিক নহে?

ফরাসী সৈন্য বিভাগে সৈনিকদিগকে যে শিক্ষা দেওয়া হয়, তাহার মধ্যে যৌনব্যাধি হইতে নিরাপদ থাকিবার এবং গর্ভনিরোধ বিষয়েও শিক্ষা দেওয়া হয়, কারণ ইহা এক অবধারিত সত্য যে, সৈনিকগণ নিশ্চিতরূপেই ব্যভিচার করিবে ১৯১৯ খৃষ্টাব্দের ৩রা মে তারিখে ফরাসীর ১২৭ ডিভিশনের উইং কমান্ডার সৈনিকদের নামে নিম্নোক্ত বিবৃতি প্রচার করেঃ

জানিতে পারা গেল যে, সামরিক বেশ্যালয়ে সশস্ত্র সৈনিকদের ভীড় হওয়ার অভিযোগ করা হইয়াছে। তাহাদের অভিযোগ এই যে, সশস্ত্র সৈনিকেরা ঐ স্থানে একেবারে তাহাদের ইজারা কায়েম করিয়া লইয়াছে এবং অন্য কাহাকেও কোন সুযোগ দেওয়া হয় না। সৈনিকদের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে গণিকা বৃদ্ধির জন্য হাই কম্যান্ড চেষ্টা করিতেছে। কিন্তু যতদিন ইহার ব্যবস্থা না হইতেছে, ততদিন এতদ্বারা সশস্ত্র সৈনিকদিগকে জানান যাইতেছে যে, তাহারা যেন বেশীক্ষণ ভিতরে না থাকে। তাহারা আপন কামরিপু চরিতার্থ করিতে যেন একটু তাড়াতাড়ি করে।

চিন্তা করিয়া দেখুন, এই বিজ্ঞপ্তি পৃথিবীর একটি সুসভ্য সরকারের সামরিক বিভাগ হইতে যথারীতি সরকারীভাবে প্রচার করা হইতেছে। ইহার অর্থ এই যে, ব্যভিচার যে নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীতে দুষণীয় হইতে পারে এমন কল্পনাও তাহাদের মন ও মস্তিস্ক হইতে মুছিয়া গিয়াছিল। সমাজ, দেশের আইন এবং সকলের মন হইতেই এই ধারণা বিদূরিত হইয়াছিল। (যে সকল সৈনিকদের নৈতিক অবস্থা এইরূপ, তাহারা যখন বিজয়ীর বেশে কোন দেশে প্রবেশ করে, তখন সেই দেশের নারী সমাজের সম্ভ্রম-সতীত্বের কি ভয়াবহ পরিণাম হইতে পারে, তাহা সহজেই অনুমান করা যায়। সামরিক বাহিনীর ইহা এক প্রকারের নৈতিক মান। অপর এক প্রকার নৈতিক মান কুরআন উপস্থাপিত করিতেছেঃ ‘মুসলমানগণ জগতে ক্ষমতার অধিকারী হইলে তথায় তাহারা নামাজ কায়েম করে , যাকাত আদায় করে, পুণ্য কাজের জন্য আদেশ করে এবং গর্হিত কার্যে বাধা দান করে।’ এক ধরনের সৈনিক ষন্ডের ন্যায় ঘুরিয়া বেড়ায়। অন্য ধরনের সৈনিক এই জন্য ক্ষমতা হস্তগত করে যে, মানবীয় নৈতিক মর্যাদার রক্ষণাবেক্ষণ করিবে এবং মানুষকে পবিত্রতা শিক্ষা দিবে। মানুষ কি এতই অন্ধ হইয়া পড়িয়াছে যে, এতদুভয়ের পার্থক্য নির্ণয় করিবে না?)

প্রথম মহাসমরের কিয়তকাল পূর্বে ফ্রান্সে একটি এজেন্সী প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। কোন নারীর অবস্থা ও নৈতিক চালচলন যেইরূপ হউক না কেন, সকল অবস্থাতেই তাহাকে এক নুতন পরীক্ষার জন্য উদ্বুদ্ধ করাই উক্ত এজেন্সীর কাজ ছিল। কোন পুরুষ কোন নারীর সহিত যৌন সম্পর্ক স্থাপন করিতে ইচ্ছা করিলে তাহাকে শুধু সেই নারীর ঠিকানা বলিয়া দিতে হইত। তদুপরি প্রাথমিক ফিস হিসাবে পঁচিশ ফ্রাংক উক্ত এজেন্সীতে দাখিল করিতে হইত। অতপর সেই নারীকে উক্ত কাজের জন্য সম্মত করা এজেন্সীর কর্তব্য হইয়া পড়িত।

এই এজেন্সীর রেজিস্টার দৃষ্টে জানা গিয়াছে যে, ফরাসী সমাজের এমন কোন শ্রেণী ছিল না যাহারা বহু সংখ্যক লোক এই এজেন্সীর মাধ্যমে ব্যবসা করে নাই। এই সকল কার্য ফরাসী সরকারের নিকট গোপন ছিল না।   -পল ব্যুরো, পৃ.১৬

তাহাদের নৈতিক অধপতন কতখানি চরমে পৌছিয়াছিল, সে সম্পর্কে পল ব্যুরো বলেনঃ

ফ্রান্সের কতিপয় জেলায় এবং বড় বড় শহরের জনবহুল অঞ্চলগুলিতে নিকটতম আত্মীয়ের মধ্যে, এমন কি পিতা-কন্যা ও ভ্রাতা-ভগ্নির মধ্যে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ঘটনা বিরল ছিল না।

অশ্লীলতার আধিক্য

প্রথম মহাসমরের পূর্বে ফ্রান্সের এটর্নি জেনারেল মশিয়ে বুলো (M.Bulot) তাঁহার এক রিপোর্টে জানান যে, যে সকল নারী তাহাদের দেহ ভাড়া খাটাইয়া জীবিকার্জন করিত, তাহাদের সংখ্যা পাঁচ লক্ষ ছিল। কিন্তু তথাকার দেহ ব্যবসায়ী নারীদের সহিত ভারতীয় উপমহাদেশের বারাঙ্গনাদের তুলনা করিলে চলিবে না। ফ্রান্স একটি সুসভ্য ও উন্নত দেশ। তথাকার যাবতীয় কার্য ভদ্রতা ও সুব্যবস্থার সহিত ব্যপক আকারে করা হইয়া থাকে। সংবাদপত্র, চিত্র, পোস্টকার্ড, টেলিফোন, ব্যক্তিগত আমন্ত্রণপত্র প্রভৃতি যাবতীয় শিষ্টাচারসুলভ পন্থায় গ্রাহকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। মানুষের বিবেক কখনও এ সকল কার্যের জন্য তিরস্কার করে না, বরং যে সকল নারী এই ব্যবসায়ে অধিকতর ভাগ্য অর্জন করিবার সুযোগ পায়, তাহারা অধিকাংশ সময়ে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর মধ্যে যথেষ্ট কর্তৃত্ব করিতে পারে। গ্রীস সভ্যতার কালে এই শ্রেণীর নারীদের যেরূপ হইয়াছিল, ইহাদেরও তদ্রূপ হইয়াছে।

ফরাসী সিনেটের জনৈক সদস্য মশিয়ে ফারদিনান্দ দ্রিফু (M.Ferdinand Dreyfus) বলেন যে, বেশ্যাবৃত্তি এখন আর ব্যক্তিগত ব্যপার নহে। ইহার এজেন্সীর দ্বারা যে আর্থিক লাভ হয়, তাহাতে ইহা একটি ব্যবসায় এবং সুসংগঠিত শিল্পে পরিণত হইয়াছে। ইহার কাঁচামাল সরবরাহ করিবার এজেন্ট স্বতন্ত্র ও অল্প বয়স্কা বালিকাদিগকে এই ব্যবসায়ের পণ্যদ্রব্য হিসাবে আমদানী রপ্তানী করা হয়। এখানে দশ বৎসরের কম বয়সের বালিকার চাহিদা অত্যন্ত অধিক।

পল ব্যুরো বলেনঃ

ইহা একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। ইহা সুসংগঠিত উপায়ে বেতনভোগী উচ্চ কর্মচারী ও কর্মী দ্বারা পরিচালিত হইতেছে। প্রচার, লেখক, বক্তা, চিকিৎসক, ধাত্রী ও ব্যবসায়ী, পর্যটক এখানে চাকুরী করে। ইহাতে বিজ্ঞাপনের সাহায্য লওয়া হয় এবং প্রদর্শনীর নুতন নুতন পন্থা অবলম্বন করা হয়।

অশ্লীলতার এই আড্ডাগুলি ব্যতীতও হোটেল, চা-খানা, নৃত্যশালা প্রভৃতিতে প্রকাশ্যভাবে বেশ্যাবৃত্তি চলে। কোন কোন সময়ে আবার পাশবিক অত্যাচার এবং চরম নিষ্ঠুরতা চলে। ১৯১৪ খৃস্টাব্দে একবার ফ্রান্সে একটি নগরের নরপতিকে (Mayor) হস্তক্ষেপ করত একটি বালিকার প্রাণ রক্ষা করিতে হইয়াছিল। উক্ত বালিকাটিকে সারা দিনে সাতাইশ জন গ্রাহকের মনতুষ্টি করিতে হইয়াছিল এবং তাহার পরও বহু গ্রাহক অপেক্ষমাণ ছিল।

প্রথম মহাসমরে ব্যবসায়ী বেশ্যালয় ব্যতীতও এক প্রকার দাতব্য বেশ্যালয় স্থাপনের গৌরব অর্জন করিয়াছিল।  যুদ্ধকালে যে সমস্ত দেশপ্রেমিক নারী ফরাসী দেশের নিরাপত্তা রক্ষাকারী বীরগণের মহান সেবা করিয়া অবৈধ পিতৃহীন সন্তান লাভ করিয়াছিল তাহারা এর সম্মানসূচক উপাধিতে ভূষিতা হইয়াছিল। এই প্রকার ইতর ধারণাকে ভাষায় রূপান্তরিত করা সম্ভব নহে। এই সকল নারী সুসংগঠিত উপায়ে বেশ্যাবৃত্তি করিতে থাকে এবং ইহাদের সাহায্য করা দুর্বৃত্ত শ্রেণীর লোকদের নৈতিক কর্তব্য হইয়া পড়ে। বহুল প্রচারিত ফ্রানটাসিও (Frantasio) ও লাভি প্যারিসিয়া (Lavie Parisiemme) কর্মকুশল ব্যাক্তিদের দৃষ্টি এই সকল নারীদের প্রতি আকৃষ্ট করিবার ব্যাপারে চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করিয়াছিল। ১৯১৭ খৃস্টাব্দের প্রারম্ভে শেষোক্ত পত্রিকাটির একটি সংখ্যায় উক্ত নারীদের ১৯৯টি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হইয়াছিল।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url