Ad

নিজেকে সবাই ভাল মনে করে এ বিষয়ে আদর্শের প্রচারের ধরন।

 

নিজেকে সবাই ভাল মনে করে

এ ব্যাপারে আলোচনার পূর্বে মানব মনের কতিপয় দুর্বলতা সম্পর্কে অবহিত হওয়া একান্ত আবশ্যক। কারন, সঠিকরূপে রোগ নির্ণয়ের উপর উপযুক্ত চিকিৎসা নির্ভর করে।

১। স্বভাবতই প্রত্যেক ব্যাক্তি নিজের সম্পর্কে ভাল ধারণা পোষণ করে। কোন ডাকাত, চোর অথবা খুনী সকলেরই নিজের সম্পর্কে এ ধারণা রয়েছে যে সে নিরপরাধী। কোনো জেলখানায় কয়েদির সঙ্গে কিছুক্ষণ আলোচনা করলেই আপনি এ কথা বলতে বাধ্য হবেন যে হয় সকল কয়েদি পূর্ব থেকেই ঠিক করে নিয়েছে যে তারা সবাই নিজেদেরকে নিরপরাধ বলে প্রকাশ করবে, আর না হয় আপনাকে ধরে নিতে হবে- নিশ্চয় সরকার এদের উপর প্রকাশ্য অত্যাচার চালাচ্ছে। না বুঝে না শুনে এ সকল নিরপরাধ ব্যাক্তিকে কারাগারে আবদ্ধ রেখেছে। অথচ এ দুটো ধারনার মধ্যে একটিও সত্য নয়। কারণ অনুসন্ধানে সেই আগের কথায় আসতে হয় যে, মানুষ নিজের সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করে। যেমন, কোন ডাকাত আজীবন নিরপরাধ মানুষের গলায় ছুরি চালিয়েছে, নির্দয়ভাবে নিরীহ পথচারীকে হত্যা করেছে, মানুষের অর্থ-সম্পদ লুট করে নিয়েছে, সেও নিজেকে দয়ালু এবং মানুষের উপকারী বলে মনে করে। তার দৃষ্টিতে সে মনে করে, লুণ্ঠিত মালের কিছু অংশ আমি তো দীনহীন ফকির মিসকিনদের মধ্যেও দান করি এতে আর এমন কি হয়েছে? কোন হত্যাকারী হয়ত এজন্য নিজেকে নিরপরাধ বলে মনে করে থাকে যে, তার ধারণা অনুযায়ী সে নিছক আত্নরক্ষার উদ্দেশ্যে গুলি বা অস্ত্র চালিয়েছে, আর ঐ ক্ষেত্রে সে তা করতেও পারে। অনুরূপভাবে কোন চোর, এই বলে নিজেকে নিরপরাধ মনে করে যে তার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কোথাও সে চাকুরী পাচ্ছেনা আর সে এতো নিষ্ঠুরও নয় যে হাত পা গুটিয়ে ঘরে বসে থাকবে আর তার ছেলেমেয়ে না খেয়ে ক্ষুধার তাড়নায় তারই সামনে অকাল মৃত্যুবরণ করবে। কাজেই জীবন রক্ষার তাগিদে সে অপরের ঘরে চুরি করতে বাধ্য হয়েছে।

এভাবে প্রত্যেক অপরাধী ব্যক্তি নিজের কাজকে বৈধ প্রমাণ করার জন্য বিভিন্ন বুদ্ধির আশ্রয় নিয়েছে। অপরাধীর সংগে আলোচনা করলেই দেখা যাবে নিজের সাফাই ও পবিত্রতার সপক্ষে সে কিরূপ যুক্তির অবতারণা করে। এতো গেলো সে সব লোকের কথা, যারা অপরাধী ও সাজা প্রাপ্ত এবং যাদের কে দুনিয়ার মানুষ অপরাধী বলে মনে করে। এ ছাড়া আরো যেসব লোক রয়েছে দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি কাজ-কারবারের মাধ্যমে যাদের সঙ্গে আমরা জড়িত, এ ক্ষেত্রে তারা কিরূপ ভূমিকা গ্রহণ করে, সে সম্বন্ধে এবার আলোচনা করা দরকার।

বড়ো ছোট যে কোন ব্যক্তিরই ধারণা এই যে, সে যা বলে সেটাই ঠিক এবং নির্ভুল। মানব মনে প্রথম জন্মগত দুর্বলতা হলো যে সব সময়ই নিজেকে নিরপরাধ বলে মনে করে এবং নিজের কাজকে মনে করে নির্ভুল।

২। আমরা দেখি একটা লোক- তা সে যত ভুলের মধ্যেই থাকুক না কেন, অন্য কেউ তার কাজে ছিদ্রান্বেষণ অথবা কোন ত্রুটি নির্দেশ করলে, তা সে কোনভাবেই বরদাশত করতে পারেনা। তাই দেখা যায়, যখনি কোন ব্যক্তির কোনরূপ ত্রুটি বা দুর্বলতা নির্দেশ করা হয়, তখন ঐ ব্যক্তি রাগে ফেটে পড়ে এবং তার মধ্যে বিরোধিতার ভাব পরিলক্ষিত হয়। যত যুক্তিই তাকে দেখানো হোক না কেন, সে তার ত্রুটি এবং দুর্বলতা ঢাকার জন্য সাফাই গাইতে গিয়ে বহু রকমের যুক্তি প্রমাণ পেশ করবেই। এরও একমাত্র কারণ হলো- যেহেতু প্রত্যেকেই মনে করে যে তার মত ই নির্ভুল।

এসব দুর্বলতাকে সামনে রেখেই আপনাকে চিন্তা করতে হবে যে, সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে আপনার কিরূপ ভূমিকা গ্রহণ করা কর্তব্য। আপনি কারোর দুর্বলতা এবং ত্রুটি নির্দেশ করলেই সে আপনার কথা মেনে নেবে বা সংশোধনের জন্য এগিয়ে আসবে, এটা কিছুতেই মনে করবেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এমন লোকের সংগে আপনার সাক্ষাত ঘটবে যে নিজেকে হয়ত মনে করে সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত এবং তার মত এবং পথকে সে সঠিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত মনে করে হয়ত বহু যুক্তি প্রমাণও খুঁজে বের করবে। এমনকি যুক্তি সংগত কিছু উত্থাপন না করতে পারলেও  বারবার একথা বলার চেষ্টা করবে যে, আমার কথা আপনার যুক্তি প্রমাণের তুলনায় একেবারে নির্ভুল না হলেও নেহায়েত অযৌক্তিক বলেও উড়িয়ে দিতে পারবেন না। এ অবস্থায় আপনি তাঁকে সংশোধনের যত চেষ্টাই করুন না কেন সে কিছুতেই তা গ্রহণ করবে না বরং ক্রমশঃ আপনার থেকে দূরে সরে যাবে। ফলে আপনার মধ্যে নৈরাশ্য ভাবের উদয় হবে। আপনি মনে করতে থাকবেন যে সৎ কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখতে গিয়ে মানুষের সংগে আপনার সম্পর্ক বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নিঃস্বার্থ কাজে এরূপ জটিলতার সৃষ্টি সত্যিই বিরক্তিকর। কেননা, যেক্ষেত্রে আপনার একান্ত ইচ্ছা থাকে মানুষের সংগে নিকটতর এবং প্রীতিকর সম্পর্ক স্থাপন করা, যার সাহায্যে আপনি সুষ্ঠু চিন্তার খোরাক দিতে এবং তাদের ভুল পথ থেকে বিরত রাখতে সক্ষম হবেন, সে স্থলে যখন পূর্বেকার সম্পর্কটুকুও বিনষ্ট হতে থাকে, তখন নিশ্চয় আপনার মধ্যে বিরক্তকর উদ্রেক হওয়াটা স্বাভাবিক। তাই দেখা যায়, কোন ব্যাক্তি দু’একবার এ ধরনের বিরক্তি অবস্থার সম্মুখীন হলে পরবর্তীতে মানুষের আস্থা হারানোর ভয়ে কোন অন্যায় বা অসৎ কাজের প্রতি দৃষ্টি পড়লেও সে দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় এবং বিরক্তিপূর্ণ স্বরে বলে থাকে, মানুষের সংগে সম্পর্ক খারাপ করে লাভ কি, এসব লোকও কি কোন কথা শুনবে?

এ ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কেননা, কোন মতবাদ বা আদর্শ প্রচারকারী যদি এ ভূমিকা গ্রহণ করেন, তাহলে দুনিয়ার মানুষের অন্তরে প্রতিষ্ঠিত ভাবধারার বিরোধী কোন নতুন বিষয়ই উত্থাপন করা সম্ভব হবে না। ফলে অন্যায়, অবিচার,জুলুম-অত্যাচারে জর্জরিত এ বিশ্বজাহানকে সংশোধন এবং সঠিক পথে পরিচালনার জন্য যে কোন প্রচেষ্টা, যে কোনো আন্দোলনের ধারাই চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। বরং আদর্শ প্রচারকারীকে প্রথমেই ভেবে নিতে হবে যে, কোন কর্মপন্থা অবলম্বন করলে সে মানুষের মধ্যে আস্থাভাজন হতে পারবে। অবশ্য ব্যক্তি, স্থান ও কালের সংগে সামঞ্জস্য রেখেই এ কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। কেননা, পরিবেশ এবং রুচির বিভিন্নতার দরুণ অনেক সময় একই কর্মপদ্ধতি সর্বত্র কার্যকরী হয় না। এমনিভাবে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হলে এবং মানুষের হৃদয়ে স্থান করতে পারলে, তারা শুধু কানের সাহায্যেই শুনবে না বরং সত্য প্রচারকের কথা শোনার জন্য তাদের হৃদয় মনও ব্যাকুল হয়ে উঠবে।

এখন প্রশ্ন হল, মানুষের মন জয় করার পন্থা কি? এ ব্যাপারে মজ্জাগত যে ব্যাধির কথা উপরে বর্ণিত হয়েছে, তা স্মরণ রাখাই যথেষ্ট। অর্থাৎ ছোট-বড় যত রকম অপরাধই হোক, মানুষের প্রকৃতিই হলো এই যে, সে নিজের ভুল কখনই স্বীকার করতে রাজি হয়না। প্রতিটি ভুলকে নির্ভুল প্রমাণ করার জন্য একটা না একটা যুক্তি তার থাকবেই। এমতবস্থায় আপনার প্রথন দায়িত্ব হলো সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তির সংগে গভীরভাবে মেলামেশা করা এবং অকপটে তার সাথে আলাপ-আলোচনা করা।

একাধিকবার মেলামেশার মাধ্যমে আপনি তার মানসিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে থাকবেন। আপনাকে দেখতে হবে এ ব্যক্তির অসংখ্য দোষ ত্রুটির মধ্যেও কি কি সদগুনাবলী রয়েছে। কেননা পৃথিবীতে এমন লোক অতি বিরল, যার মধ্যে কোন সদগুণ নেই এবং শুধু অসদগুণাবলীতে সে পরিপূর্ণ। কোন ব্যক্তি যতই অসৎ চরিত্রের হোক না কেন, তার মধ্যে সৎগুণ নিশ্চয়ই কিছু থাকবে। আপনি তখন সকল দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে তার সদগুণাবলীর প্রতিই লক্ষ্য করবেন এবং এ জন্য তার প্রশংসা করবেন। তবে এ পদ্ধতিতে সম্পর্ক স্থাপনকালে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন এটা তোষামোদ বা ছলচাতুরীর রূপ ধারণ না করে। বরং তার সদগুণাবলীর প্রশংসা আপনাকে দরদ এবং আন্তরিকতার সংগে করতে হবে, যা সত্যি সত্যি তার মধ্যে রয়েছে। আপনি সত্যি যদি আন্তরিকতার সংগে তার সদগুনাবলীর প্রশংসা করে থাকেন, তাহলে সে নিশ্চয়ই আপনার নিকট তার সব কথা অকপটে ব্যক্ত করবে এবং ক্রমশঃ আপনাকে আপনজন বলে ভাবতে শুরু করবে, আর মনে করবে একজন সত্যিকার সহানুভতিসম্পন্ন ব্যক্তিরুপে। এর কারণ হচ্ছে, মানুষ স্বভাবতঃই চায় অন্যেরা তার স্বীকৃতি দিক। প্রশংসা অর্জনের এ একান্ত বাসনা যে কোন মানুষের মধ্যেই অল্প-বিস্তর রয়েছে। এসব বাস্তব বিষয় কে সম্মুখে রেখেই কাজ করতে হবে। স্মরণ রাখা দরকার, এমন কর্মী দ্বারা সমাজের কোনরূপ সংস্কার বা মঙ্গল সাধনের আশা করা যেতে পারে না, যে সর্বদা নিজেকে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী বলে মনে করবে আর সমালোচনা করবে অপরের যাবতীয় দোষত্রুটির।

এ ভাবে সহানুভূতি ও সদ্ব্যবহারের দ্বারা কারো হৃদয় জয় করার পর আপনি মনে করতে পারেন যে, এ ব্যক্তি দ্বারা এখন কিছু সৎ কাজ করানো সম্ভব হবে। এখন যদি আপনি সহানুভুতির সংগে তার চরিত্রের এমন কোন দোষ-ত্রুটির প্রতি অঙ্গুলী নির্দেশ করেন, যা পরিহার করা তার জন্যে তেমন কিছু অসুবিধাজনক নয় তাহলে সে অনায়াসেই তা সংশোধনের জনে এগিয়ে আসবে এবং আপনার যে কোন পরামর্শ বা সদোপদেশ গ্রহণ করতে মোটেই দ্বিধাবোধ করবেনা। অনুরূপভাবে তার এ সত্যোপলব্ধি এবং সংশোধনী গ্রহণ করার মনোভাবেরও যদি আপনি প্রশংসা করেন তাহলে দেখতে পাবেন আরো দিগুণ উৎসাহ-প্রেরণা নিয়ে সে দিনের পর দিন সত্যের দিকে অগ্রসর হয়ে চলছে এবং ন্যায় ও সত্যকে গ্রহণ করার জন্যে তার মধ্যে এক নতুন শক্তি ও প্রেরণার সৃষ্টি হচ্ছে। এমনি ভাবে ধৈর্য ও সহানুভূতির সংগে সংস্কার ও সংশোধনের কাজে এগিয়ে আসলে ইনশাআল্লাহ অল্পদিনের মধ্যেই সে ব্যক্তি সত্য পথের সন্ধান লাভ করবে। আদর্শের প্রচার এবং প্রসারের ক্ষেত্রে প্রত্যেক প্রচারককে স্মরণ রাখতে হবে যে, কারো মন-মগজকে পরিশুদ্ধ করা মোটেই ছেলে খেলা নয়। ছলচাতুরীর দ্বারা কাউকে উচ্চ মর্যাদা থেকে অপসারণ করে অপদস্ত করার জন্য যে কোন একটি সাধারণ প্রতারণামূলক চালবাজীই যথেষ্ট। কিন্তু নৈতিক অধঃপতনের অতল গহ্বর থেকে হাতে ধরে মানুষকে মানবতার উচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত করতে হলে চেষ্টা সাধনার প্রয়োজন। এ জন্য সত্যিকার সহানুভূতিশীল ব্যক্তিকে শরীরে রক্ত পানি এবং মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়।

সার কথা হলোঃ আদর্শ প্রচারের ক্ষেত্রে মানুষের মনে অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করতে হলে ন্যায়সঙ্গতভাবে মানুষের চরিত্রে যে সদগুণাবলী রয়েছে, তাকে প্রথম অবলম্বন হিসেবে বেছে নিতে হবে এবং সেগুলোকে যথার্থ মর্যাদা দিতে হবে। কারো তোষামোদ করা এবং সত্যিকার প্রশংসা করার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য রয়েছে। এসব বিষয়কে সর্বদাই সম্মুখে রেখে কাজ করতে হবে। কোনো মানুষের সদগুণাবলী এবং সৌন্দর্যের আলোচনা আপনার নিজের মধ্যেও এক সহানুভূতির উদ্রেক করবে। এটা সর্বজন স্বীকৃত যে, সৎ কাজে আহ্বান এবং অসৎকাজ থেকে বিরত রাখার কাজ যদি সহানুভূতির সংগে না করা হয়, তাহলে কোনো সদোপদেশ কার্যকরী হয়না। যেসব সদগুণাবলী মানুষ নিজের মধ্যে সহজেই পয়দা করতে পারে সর্বপ্রথম তাকে সেদিকেই আহবান জানাতে হবে।

মানুষের সংগে সম্পর্কোনয়নের ব্যাপারে এ পর্যন্ত বেশ কিছু প্রস্তাব আপনাদের সম্মুখে উত্থাপন করা হয়েছে। তবে সেই সঙ্গে এ বিষয়ের প্রতিও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে, যাতে প্রচারক কতৃক এমন কোনো ভূমিকা গ্রহণ না করা হয়, যার কারনে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন এবং উন্নয়নের কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। সম্পর্ক সুদৃঢ় এবং ছিন্ন হওয়ায় উভয় কারণকে সম্মুখে রেখে কাজ করলে এ ব্যাপারে আরো বহু ফল লাভের আশা করা যেতে পারে। কি কি কারনে সম্পর্কোন্নয়ন বিঘ্নিত হয়, তা একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করলে যে কেউ উপলব্ধি করতে পারে। তবে সাধারণতঃ যে সকল কারনে সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং পারস্পরিক সর্ম্পক নষ্ট হয় তার কারণসমূহ হলো নিম্নরূপঃ

১. নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কিছু দেখেই মানুষ ক্রুদ্ধ হয়ঃ

কম বেশি এ দুর্বলতাটুকু সকলের মধ্যেই দেখা যায় যে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কিছু দেখেই মানুষ ক্রুদ্ধ হয়। বিশেষ করে ঘরের চাকর-চাকরানী, ছেলে-মেয়ে এবং নিজের ছাত্র-ছাত্রীরাই বড়দের রোষানলের সম্মুখীন হয়ে থাকে বেশী। কিন্তু সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে অন্যান্য গুণাবলীর মত ক্রোধকেও আয়ত্তাধীন করা কর্তব্য। কথায় কথায় বদমেজাজি এবং খিটে খিটে ভাব দেখানো হলে কেউ আপনার সংস্পর্শে আসবেনা এবং আপনার সংগে মেলামেশার ইচ্ছা করবে না। ফলে খুব শীঘ্রই এ দুর্বলতার প্রতিক্রিয়া নিকটতম পরিবেশে ছড়িয়ে পড়বে এবং অবশেষে আদর্শ প্রচারে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে। এরই ফলে আদর্শ প্রচার বা সৎকাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধের ক্ষেত্রে এমন অনেক লোককে দেখা যায়, যারা নিজেদের বদমেজাজি এবং অসদাচরণের দরুন নিজ পরিবেশে আশানুরূপ কৃতকার্য হতে পারেনা।

২.নিজের ত্রুটি-বিচ্যুতি অপেক্ষা অপরের দোষত্রুটির প্রতি দৃষ্টি অধিক নিবন্ধ হয়ঃ

নিখুঁত চরিত্রের অধিকারী, সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত লোকের সংখ্যা সমাজে অতি বিরল। সহকর্মী এবং দৈনন্দিন কাজে জড়িত ব্যক্তিদের সঙ্গে আদান-প্রদান এবং কাজকারবারে- যেকোন ব্যক্তিরই হোক না কেন অল্পবিস্তর ত্রুটি-বিচ্যুতি প্রকাশ পাওয়া স্বাভাবিক। তবে এটা মানুষের স্বভাবজাত যে, নিজের ত্রুটি- বিচ্যুতি অপেক্ষা অপরের দোষত্রুটির প্রতিই দৃষ্টি অধিক নিবদ্ধ হয়ে থাকে। একে অপরের মধ্যে সামান্যতম দুর্বলতার সন্ধান পেলেই অমনি সমালোচনামুখর হয়ে ওঠে। কাজেই, যেহেতু প্রত্যেকেই নিজের সম্পর্কে ভাল ধারণা পোষণ করে থাকে, তাই একে অপরের ত্রুটি নির্দেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই তার অনুভূতিতে ভীষণ আঘাত অনুভূত হয়। এ কারণে অসাবধানতার সঙ্গে কারো ত্রুটি নির্দেশ বা কোন রূপ সমালোচনা পারস্পরিক সম্পর্কের বিশেষভাবে ক্ষতি সাধন করে। এক কথায় মানুষকে সংশোধনের উদ্দেশ্য তাদের সংগে সম্পর্ক স্থাপনকালে তাদের সকল দোষত্রুটিকে উপেক্ষা করতে হবে এবং প্রথম অবস্থায় তার যাবতীয় সমালোচনা থেকে বিরত থাকতে হবে। সমালোচনা থেকে বিরত থাকার অর্থ এটা নয় যে তার যাবতীয় দুর্বলতা এবং দোষত্রুটি থেকে সম্পূর্ণরূপে দৃষ্টি এড়িয়ে তার সংগে সবসময়ের জন্য সম্পর্ক কায়েম করতে হবে। বরং এর অর্থ হচ্ছে, যে সকল মানুষের মধ্যে কোনরূপ দুর্বলতা বা দোষত্রুটি রয়েছে এবং সংশোধনকারীও স্বয়ং সে সম্বন্ধে জ্ঞাত আছেন, এমতবস্থায় এ বিষয়ে বারংবার আলোচনা না করা। কেননা, এতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সংশোধিত হবার চাইতে বিদ্রোহী হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশী থাকে।

৩.মানুষকে এ ধারণা আনন্দ দেয় যে, সে যাবতীয় দুর্বলতা থেকে মুক্তঃ

মানুষকে এ ধারণা সত্যিই আনন্দ দেয় যে, সে যাবতীয় দুর্বলতা থেকে মুক্ত। অথচ কোন মানুষই এ দাবী করতে পারেনা যে, তার মধ্যে কোন প্রকার দুর্বলতা বা দোষ-ত্রুটি নেই। কিন্তু এ সত্ত্বেও মানুষ চায় যে অন্ততঃ নিজের সম্পর্কে নিজের ধারণাটুকু ভাল থাকুক। মানুষের আত্নতুষ্টি লাভের এ প্রবণতা অভিব্যক্তি বিভিন্নরুপে ঘটে অপরের দুর্বলতাকে ঘৃণা ভরে উন্নাসিকতার মাধ্যমে প্রকাশ করে, ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে, কাউকে বোকা প্রমাণ করে,কারো অদূরদর্শিতা বা বুদ্ধিহীনতার দিকে ইঙ্গিত করে এবং এমন হাবভাব বা বর্ণনাভঙ্গি করে, যাতে নিজের মাহাত্ম্য এবং শ্রেষ্ঠত্ব ফুটে ওঠে। তার কারণ মানুষের এ ধরনের ভূমিকা তার মনে এক বিশেষ তৃপ্তির যোগান দেয়। এ জন্যই নিজের দুর্বলতাকে ঢাকার জন্য মানুষ অসংখ্য উপায় অবলম্বন করে। আপনি অপরকে সংশোধনের দায়িত্ব পালন করছেন। নিশ্চয়ই এটা ভাল কাজ। কিন্তু উপরোক্ত কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করলে সত্যিকার সংশোধন তো দূরের কথা, সংশোধনের পথই সম্পূর্ণরূপে রুদ্ধ হয়ে যাবে এবং পারস্পরিক সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠবে। ফলে আপনার কথা শুনে মানুষের অন্তঃকরণ সিক্ত হওয়ার পরিবর্তে পাথরে পরিণত হবে এবং তারা পরিণত হবে ‘বদ্ধ তালায়’।

৪. মানুষ নিজেকে বড় এবং অপরকে ছোট মনে করাতে তৃপ্তি অনুভব করে থাকেঃ

নিজেকে বড় এবং অপরকে ছোট মনে করাতে আমরা বেশ তৃপ্তি অনুভব করে থাকি। এজন্যই অপরের অগোচরে আমরা তার দোষ ত্রুটির আলোচনা করি। অর্থাৎ কোন সময় চাপ প্রদানের ভয়ে বা ভদ্রতার খাতিরে যদি আমরা কারো সম্মুখে তার সমালোচনা করার সুযোগ না পাই, তাহলে অন্য সময় তার অগোচরে আমরা তা প্রকাশ করি কিংবা মনের এভাবে এমন ভঙ্গিতে ব্যক্ত করে থাকি যাতে বাহ্যতঃ মনে হয় যেন ঐ ব্যক্তির সংশোধন অত্যধিক কাম্য ছিল; ঐ ব্যক্তির জন্যে মনে হয় বক্তা অত্যন্ত দুঃখ অনুভব করছেন। অথচ এতে আসল উদ্দেশ্য হয় সেই ব্যক্তিকে খাট করা। এভাবে অন্যের অগোচরে এমনি অথবা সহানুভূতির সুরে তার দুর্বলতার আলোচনা করে এরূপ তৃপ্তি অনুভব করা, নিজের ব্যক্তিত্বকে বড় করে দেখানোই হয় এক্ষেত্রে আসল উদ্দেশ্য। এটা কুরআন বর্ণিত ‘গীবতে’র অন্তর্ভুক্ত। গীবত থেকে বেঁচে থাকার জন্যে আল কুরআনে কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সম্পর্ক বিনষ্ট করার ব্যাপারে গীবতের বিরাট প্রভাব রয়েছে। গীবতের ব্যাপারে কেবল এটাই ক্ষতিকর নয় যে, আপনি অন্যের অবর্তমানে তার দোষত্রুটি বর্ণনা করাতে তার প্রতি আপনার এবং অপরাপর শ্রোতার বীতশ্রদ্ধা ভাব সৃষ্টি হবে, বরং যার গীবত করা হয়েছে, সেও এসব কথা জানতে পারলে আপনার বিরুদ্ধে তার অন্তঃকরণে ঘৃণার উদ্রেক হবে। ফলে এভাবে পারস্পরিক সম্পর্ক তো বিনষ্ট হবেই, এ ছাড়াও বহু অঘটন ঘটারও সম্ভাবনা দেখা দেবে। মানুষের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক স্থাপন করার জন্যে তাই গীবত থেকে কঠোর ভাবে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

সমাজের মানুষের সংগে সম্পর্ক বিনষ্ট হওয়ার এ হল ক’টি বিশেষ বিশেষ কারন। একদিকে এসকল ব্যাপারে অসতর্ক থাকা এবং অপরদিকে সম্পর্কোন্নয়নের আশা পোষণ করা, এরূপ পরস্পর বিরোধী পদ্ধতিতে কিছুতেই কৃতকার্য হওয়া সম্ভব নয়। অবশ্য এটা সত্য যে, উপরোল্লিখিত দোষত্রুটি থেকে সম্পূর্ণরূপে বেঁচে থাকা খুব সহজ ব্যাপার নয়, তবে এ ধারনাও ঠিক নয় যে, এ জাতীয় দুর্বলতা সংশোধনের উর্ধে। নিশ্চয়ই এ থেকে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে। এ জন্যে কেবল ইচ্ছাশক্তি ও কঠোর সংকল্পেরই প্রয়োজন। মুমিনের সংশোধনের জন্য তওবাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। তওবা বলতে আমরা বুঝি আমাদের কৃত অপরাধের জন্যে অনুতাপ-অনুশোচনা দ্বারা সহজভাবে আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা করা এবং ভবিষ্যতে উক্ত গর্হিত কাজে প্রবৃত্ত না হওয়ার জন্য তার কাছে কঠোরভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া। এসবের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমরা চাই আমাদের সত্যিকার মালিক ও প্রভুকে সন্তুষ্ট করতে।

যে সকল দোষত্রুটির বিষয় ওপরে বর্ণিত হয়েছে, সেগুলো কারোর চরিত্রে দেখা দিলে যে ক্ষতি সাধিত হয়, সেদিকে কিছুটা ইঙ্গিত ইতিপূর্বে করা হয়েছে। অর্থাৎ এতে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক বিনষ্ট হয়। ফলে মানুষের নিকট দিনের দাওয়াত পৌছানো বড় কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু যেসব মানুষের দৃষ্টি সম্পুর্ণরূপে দুনিয়ার প্রতিই নিবদ্ধ, দুনিয়ার অর্থ সম্পদ, মান-মর্যাদা, যশ-গৌরব অর্জনই যাদের জীবন চরমতম লক্ষ্য, তারাও তো এসব দোষত্রুটি এবং এর প্রতিক্রিয়া থেকে বাঁচতে চায়। এ উদ্দেশ্যে তারা সব রকমের চেষ্টা চরিতও করে। এমন অনেক লোক রয়েছে যারা নেতৃত্ব ফলাবার, ব্যবসায় সম্প্রসারণ করার অথবা পার্থিব কোন মর্যাদা লাভের আশা ছাড়া জীবনের অন্য কোন উদ্দেশ্যই রাখে না, তারাও তো এসব দোষত্রুটি অপকারিতা সম্পর্কে জানে এবং এ থেকে বাঁচার জন্যে অনবরত চেষ্টা করে থাকে। এদেরকে দেখেও আমাদের শিক্ষা গ্রহণের অনেক কিছু রয়েছে। এ ধরনের লোকেরা যদি এ জাতীয় দুর্বলতা এবং দোষত্রুটি অপকারিতা থেকে বাঁচার জন্য কঠোর সংকল্প গ্রহণ করতে পারে এবং হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার মানসে যাবতীয় মন্দ স্বভাব পরিত্যাগ করে নিজেকে সম্পূর্ণ সংযত করতে পারে, তা হলে এদের চেয়েও উচ্চতর লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্যে সংগ্রামকারীদের ভূমিকা কিরূপ হওয়া উচিত, তা সহজেই অনুমেয়। যে ব্যক্তি নশ্বর জগতকে উপেক্ষা করে অনন্ত জগতের অধিকারী হওয়ার অভিলাষী, সে এ সকল দোষত্রুটি থেকে নিজেকে মুক্ত করার শপথ নিয়ে অগ্রসর হলে নিশ্চয়ই তার মধ্যে বিপুল শক্তি সঞ্চারিত হবে।

মনের ঝাল প্রকাশ করা

মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক বিনষ্ট হওয়ার বহুবিধ কারণ থাকে। এর মধ্যে মানুষের প্রকৃতিগত উত্তেজনার একটা বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। যে কারনে এ সম্পর্ক একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। অনেক বিষয় আছে, যা অপছন্দ হবার কারনে মানুষ তার বিরুদ্ধে ইচ্ছা পুরিয়ে নানা ভাবে মনের ঝাল মিটতে চায়। এ উদ্দেশ্যে সে বহুতর উপায় অবলম্বন করে। ক্রোধ, কটু কথা, ত্রুটি অনুসন্ধান, কারো পেছনে দোষ বর্ণনা ইত্যাদি এমন অনেক উপায় আছে, যার উদ্দেশ্য মনের ঝাল প্রকাশ করা ছাড়া কিছুই নয়। মানুষের এ জাতীয় মানসিক অবস্থাই তাকে অপরের বিরুদ্ধে অপবাদ রটাতে এবং অপরের দোষত্রুটিকে ফলাও করে প্রকাশ করতে বাধ্য করে। মোটকথা, মানুষ তার এ মানসিক প্রবণতার দরুন নানবিধ নৈতিক দুর্বলতায় জড়িত হয়ে পড়ে। মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার খাতিরে এদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে যে, কদাচিৎ নিজের ক্রোধ চরিতার্থ করার জন্যে যেন এ প্রবণতার আশ্রয় না নেয়া হয়। এ মানসিক অবস্থার উদ্ভব হলে, তার দ্বারা এমন সব কাজ অনুষ্ঠিত হয় যার ফলে মানুষের মন তার প্রতি বিরূপ হয়ে ওঠে এবং তাদের মধ্যকার দূরত্বও বেড়ে যায়। এ মানসিক প্রবণতাকে সংযত রাখার জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলোকে সম্মুখে রাখা হলে ‘আদর্শ’ প্রচারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট কামিয়াবির আশা করা যেতে পারে।

কারোর প্রতি দোষারোপ করা অত্যন্ত সহজ । কোন ব্যাপারে কাউকে অভিযুক্ত করতে কোন বেগ পেতে হয় না, কিন্তু নিজেকে অভিযুক্তের পর্যায়ে ফেলে বিচার করাটা অত্যন্ত দুঃসাধ্য ব্যাপার। অপরের দোষত্রুটি অনুভব করার পর সুস্থ মস্তিষ্কে নিজেকে একবার তার স্থানে রেখে অবস্থা পর্যালোচনা করুন। অবশ্য এটি হবে বীরত্বের পরিচায়ক। এমতাবস্থায় আপনি দেখতে পাবেন শতকরা আশি ভাগ অভিযোগ- যা আপনি অন্যের অপর আরোপ করেছেন, তার প্রত্যেকটারই একটা যুক্তিসংগত কারন আপনি নিজেই বের করবেন। অপরের চরিত্রের ন্যায় নিজের চরিত্রকে ‘সমালোচনার দূরবীন’ দ্বারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলে একদিকে যেমন নিজের সংশোধনের পথ সুগম হবে, তেমনি অন্যদিকে অপরের ছিদ্রান্বেষণ এবং তাকে অভিযুক্ত করার প্রবণতা থেকেও রক্ষা পাওয়া যাবে, যা পারস্পরিক সম্পর্ককে বিছিন্ন করে দেয়।

তবে তার মানে এই নয় যে, সমাজ-সংশোধনের সকল প্রকার কাজ থেকে হাত গুটিয়ে বসে থাকার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। আর এর অর্থ এও নয় যে, যে কোনো অপকর্মকে বরদাশত করার অভ্যাস করতে হবে। বরং নিজের চরিত্রকে এমনি তুলনামূলকভাবে যাচাই করাতে সার্থকতা হচ্ছে এই যে, যখন আপনি নিজের প্রতি লক্ষ্য রেখে অপরের দোষত্রুটি বিচার করবেন তখন আপনি তার সংশোধনের জন্যে এমন পন্থাই গ্রহণ করবেন যাতে করে মনে হয় যেন আপনি নিজের সংশোধনেই এগিয়ে আসতেন। এটা স্পষ্ট কথা যে এমনি ভাবে অপরের অবস্থা সংশোধনে যে দরদ এবং আন্তরিকতা আপনার নীতিতে স্থান পাবে তার গুরুত্ব নিশ্চয় অনেক বেশী এবং এর প্রভাবও সুদূরপ্রসারী। এতে মানুষের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক সর্বদা মধুরতর থাকবে এবং সমাজ সংস্কারের সুসঙ্গত পন্থার উদ্ভব হবে। আপনার সম্মুখে রয়েছে একটা মহান উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। এ লক্ষ্য উপনীত হওয়ার জন্যে সর্বদাই আপনি মানুষের মনকে নিজের নিকটবর্তী করতে চান। তাই আপনি নিজের দোষত্রুটি নিজের যে কোন দুর্বলতার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতে পারেন। সেগুলোর সংশোধনে এগিয়ে আসতে পারেন। কুপ্রবৃত্তি দমনে সক্ষম হতে পারেন এবং নিজের মানসিক প্রেরনাকে নিজেই পিষ্ট করতে পারেন। কিন্তু আপনার শ্রোতার অবস্থা তো আর তেমন নয়। তার সামনে নেই কোনো উন্নততর উদ্দেশ্য- লক্ষ্য। আপনার মতো তার ভেতরের মানুষটা এতোসব বাধ্যবাধকতা, নিয়ম-কানুন মেনে চলার কোনো কারন খুঁজে পায় না। কাজেই আপনার শ্রোতা থেকে আনেক সময় এমন বহু কিছু প্রকাশ পায় যা আপনার মনঃপুত নয় এবং আপনার জন্যে হয় যথেষ্ট পীড়াদায়ক। মানুষ চায়, সে যদি কারোর সঙ্গে নম্র ও ভদ্র ব্যবহার করে, তাহলে প্রত্যুত্তরে তার সঙ্গেও সে অনুরুপ ব্যবহার করুক। সে যদি নিজের ক্রোধ ও আবেগকে সংযত রাখে, তাহলে অপরজনও যেন তার ক্রোধ-আবেগকে বে-লাগাম না করে।

অনেক লোক আছে যারা অপরকে সংশোধন করতে গিয়ে নিরাশ হয়ে এ ধরনের মন্তব্য করে থাকে যে, আমরা সবকিছু করে ফেলতে চাইলে কি হবে শ্রোতাদেরও তো এ দিকে কিছু ঝোঁক থাকা চাই। এদ্বারা তারা বলতে চায় যে, আমাদের কে যে বিষয়ে পরামার্শ দেওয়া হচ্ছে আমরা তো সে অনুপাতে কাজ করে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ; তার সঙ্গে সঙ্গে এ শর্তও তারা আরোপ করেছে যে শ্রোতাকেও সে উপদেশ গ্রহণ করার জন্যে এগিয়ে আসতে হবে। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই এ ধরনের উক্তির তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারবেন।

আসল কথা হল, যাদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক, তার মূলতঃ কেবল কল্পনাপ্রবণ মানুষ নয় এবং তাদের কর্মপ্রবণতাও আপনার ইচ্ছার অনুগত নয় যে আপনি যখন যা বলবেন তখন তাই হয়ে যাবে। বরং আপনাকে যা কিছু করতে হবে তা এমন সব লোকের মধ্যে করতে হবে যারা বিভিন্ন মেজাজ ও বিভিন্ন ভাবাবেগের অধিকারী। এমনও হতে পারে আপনার শ্রোতা মস্তবড় জ্ঞানী ও যুক্তিবাদী। আপনি তার কাছে অকাট্য যুক্তি প্রমাণ পেশ করছেন না। যার ফলে আপনার শতকরা বাসনা পূর্ণ হচ্ছেনা। আপনি যেভাবে আপনার শ্রোতাকে নিজের বক্তব্য বুঝাতে চেষ্টা করেছেন সে কিছুতেই মানতে রাজী হচ্ছে না। কেননা আপনি যাদের সঙ্গে আপনি সম্পর্ক স্থাপন করেছেন তাদের মধ্যেও ভাবাবেগ আছে, গর্ব অহংকার, বিদ্বেষ ও হঠধর্মীতাও আছে। পূর্ব পুরুষদের রীতি-নীতির ওপর তারা অন্ধ বিশ্বাস স্থাপন করে বসে আছে। এমতাবস্থায় আপনার যদি এমন কোনো ভূমিকা প্রকাশ পেয়ে যায় যার ফলে তাদের মনের গভীরে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাসে আঘাত লাগে, তাহলে মনে করতে হবে, আপনি নিজ হাতেই নিজের সমস্ত কিছু ধ্বংস করে দিয়েছেন। আপনাকে সর্বদা এ জন্যে সতর্ক থাকতে হবে যে, আপনার থেকে যাতে কোন কাজ না ঘটতে পারে যাতে অপরের অহমিকায় আঘাত লাগে এবং তার আত্নগৌরব, পক্ষপাতিত্ব, গোঁড়ামি ইত্যাদি পশু-বৃত্তিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে, তার বিশ্বাসগুলো প্রত্যক্ষ আঘাতের মুখোমুখি হয়।

আপনি হয়তো বর্ণিত উপদেশাবলীর ব্যবহারিক পদ্ধতি সম্পর্কে ইতস্তত করছেন যে তাহলে মানুষের মধ্যে উল্লেখিত থাকা অবস্থায় কিভাবে তার সংশোধন করা যাবে? তার অহংকার আত্মেম্ভরিতার কি প্রশংসা করবো? কিংবা তার বিদ্বেষ, হঠধর্মীতা এবং যাবতীয় অন্ধ বিশ্বাসকে সঠিক বলে মেনে নেব? নিশ্চয় নয়। কেননা এটা একদিকে যেমন আদর্শ প্রচারকারীর মর্যাদার পরিপন্থী, অন্য দিকে তেমনি তার মূল লক্ষ্যের জন্যেও একান্ত ক্ষতিকর। বরং এখানে যে ব্যাপারে আপনাকে বিরত থাকার কথা বলা হচ্ছে তার মূল কথা হলঃ আপনি এমন কোন পরিস্থিতির উদ্ভব করবেননা, যাতে তাদের হীন প্রবণতা আহত হয়। মূল লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার ব্যাপারে কি করা উচিত বা কি উচিত নয়- এর ফয়সালা আপনাকে প্রতি পদে পদে করতে হবে। কারণ এতে আপনার ভুল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং এ ভুলের একাধিকবার পুনারবৃত্তিও ঘটতে পারে। কিন্তু প্রতি পদে পদে যদি আপনি আপনার কাজের প্রতিক্রিয়ার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রেখে অগ্রসর হতে থাকেন, তাহলে আপনার একটা ভুল নিজের অভিজ্ঞতায় এক নতুন সংযোজনার সৃষ্টি করবে। অতঃপর আপনি যদি এসব ধারাবাহিক অভিজ্ঞতা একত্রিত করেন তাহলে তা আপনার জন্যে একান্ত উপকারী ও বাস্তব পরামর্শে পরিণত হবে। এককথায় যারা অপরের চিন্তা ধারা, মতামত এবং ভাবাবেগের ওপর প্রভাব করতে ইচ্ছুক, তাদের কে অন্যের দৃষ্টিভংগী হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করা উচিত।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url