Ad

ইসলামি আন্দোলণের বিরুদ্ধতা ও উহার কারণ

 

বিরুদ্ধতা ও উহার কারণ

 

আমাদের উদ্দেশ্য সংক্ষেপে ইহাই। এই দিকেই আমরা বিশ্বের অধিবাসীদের আহবান জানাইয়া থাকি। কিন্তু বড়ই বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, এই আন্দোলণের সর্বপ্রথম বিরুদ্ধতা হইয়াছে মুসলমানদের তরফ হইতে। অমুসলিমগণ- যাহারা এই আন্দোলনের বিরোধী হইতে পারে, আজ পর্যন্ত ইহার বিরুদ্ধে কোন কথাই বলে নাই, কোথাও কার্যত কোন বিরুদ্ধতা কেহ করেও নাই। ভবিষ্যতেও এইরূপ অবস্হা বর্তমান থাকিবে, কিনা, তাহা বলিতে পারি না; আর কতদিন পযর্ন্ত এই অবস্হা বর্তমান থাকিবে, তাহা অনুমান করাও সম্ভব নহে। কিন্তু তবুও আমাদের উপরিউক্ত দাওয়াত শ্রবণ করিয়া নাক সিটকানো, ইহাকে বিপদের পূর্বাভাষ মনে করা এবং উহার বিরুদ্ধতার জন্য সম্মুখে অগ্রসর হওয়া প্রভৃতি কোন একটি কাজও আজ পর্যন্ত অমুসলিমগণ করে নাই- করিয়াছে আমাদের মুসলমান ভাইগণ। সম্ভবত এই ধরনের অবস্হায়ই আহলে কিতাব- ইহুদী-নাসারাদের বলা হইয়াছিলঃ( ) ‘তোমরাই সবর্প্রথম ইহার অমান্যকারী হইও না।‌’

 

হিন্দু, শিখ এবং ইংরেজদের সহিত এই বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করিয়াছি। আমাদের কথাবার্তা বিস্তারিতভাবে শুনিয়া কিংবা আমাদের বই-পুস্তুক পাঠ করিয়া তাহাদের একজন লোকও আজ পর্যন্ত ইহাকে ‘সত্য নহে’ বলে নাই। কিংবা ইহার বিরুদ্ধতা করার প্রয়োজনীয়তাও তাহারা প্রকাশ করে নাই। অনেক অমুসলিম এতদূর বলিয়াছি যে, ইসলামের দাওয়াত যদি এই দেশে অনেক আগেই পেশ করা হইত এবং বহিরাগত ও স্হানীয় সবল মুসলমানই যদি ইহাকে কায়েম করিতে চেষ্টা করিতেন, তবে দেশের অবস্হা সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ হইতে পারিত। অনেক অমুসলিম এতদূর বলিয়াছি যে, কোন সমাজ বা দল যদি ঐকান্তিক নিষ্ঠার সহিত এই আদর্শ অনুযায়ী কাজ করিত, তাহার জীবন ও মৃত্যু যদি এই উদ্দেশ্যের জন্যই উৎসর্গীকৃত হইত, তবে অমুসলিমগণ ইহার অন্তর্ভুক্ত হইতে কোনরূপ দ্বিধা সংকোচ করিত না। এতদসত্ত্বেও সর্বপ্রথম আমাদের বিরুদ্ধতা করিবার জন্য মুসলিমগণই অত্যধিক তৎপর হইয়া উঠিয়াছে। 

আমাদের বিরুদ্বে কুৎসা রটনায়, নানাবিধ ভিত্তিহীন অভিযোগ উত্থাপনে ইহারাই অগ্রসর হইয়াছে। আবার মুসলমানদের মধ্যেও অধিক তৎপরতা দেখাইতেছে ধর্মপন্হী দল। সর্বাপেক্ষা মজার ব্যাপার এই যে, আমাদের উদ্দেশ্য ও দাওয়াতকে আজ পর্যন্ত কেহই বাতিল বা ‘সত্য নহে’ বলিবার সাহস করে নাই। স্বম্ভবত ইহার একমাত্র কারণ এই যে, আমাদের দাওয়াত ও আন্দোলনের উপর সম্মুখ দিক হইতে আক্রমণ (FRONTAL ATTACK) করা কাহারও পক্ষেই সম্ভব নহে। এই জন্যই কখনো পশ্চাৎ দিক হইতে, কখনো ডান দিক আর কখনো বাম দিক হইতে ইহার উপর আক্রমণ করা হয়। কখনো বলা হয়ঃ কথা তো ঠিক, তাহাতে সন্দেহ নাই; কিন্তু আন্দোলনকারীগণের মধ্যে এই দোষ বা ত্রুটি রহিয়াছে। কেহ বলে, ইহারই সত্যতা অনস্বীকার্য, তবে এইরূপ আন্দোলন পরিচালনার জন্য সাহাবাদের ন্যায় লোকদেরই দরকার আর বতর্মানে তাহাদেরকে কোথায় পাওয়া যাইবে? কখনো বলা হয়, ইহা নিঃসন্দেহে ইসলামেরই দাওয়াত, তবে এই যুগে ইহা আদৌ চলিতে পারে না। কেহ বলে এই দাওয়াতের সত্যতা সম্পর্কে কেহ টু- শব্দটি করিতে পারে না, কিন্তু মুসলমানদের বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্হার পরিপ্রেক্ষিতে ইহা গ্রহণ করা তাহাদের পক্ষে বিপজ্জনক হইবে। এখানেই শেষ নহে, মুসলমানদের মধ্য হইতে খোদার কোন বান্দাহ যদি আমাদের এই দাওয়াত কবুল করেন এবং নিজের জীবনক্ষেত্র হইতে প্রকৃত মুনাফিকী ও কর্মীয় বৈসাদৃশ্য দূর করিতে যত্নবান হন, সমগ্র জীবনকেই খোদার বন্দেগীর অধীন করিয়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত করেন, তবে তাহার ভাই পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবই সর্বপ্রথম তাহার বিরুদ্ধতা করার দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হয়। অনেক ধার্মিক ও মুত্তাকী ও এমন দেখা গিয়াছে, যাহাদের কপালে সিজদার চিহ্ন পড়িয়াছে, ধর্ম সংক্রান্ত আলোচনাই যাহাদের রসনা চব্বিশ ঘন্টা ব্যস্ত থাকে, তাহারাও তাহার বিরুদ্ধতা করিতে বিন্দুমাত্র সংকোচবোধ করে না। তাহাদের পুত্র, ভ্রাতা কিংবা কোন আত্মীয় এই আন্দোলনে যোগদান করুক ইহা আদৌ সহ্য করিতে প্রস্তুত নহে। বস্তুত আমাদের এই আন্দোলনের বিরোধিতা সর্বপ্রথম মুসলমানদের করা, তাও আবার দুরিয়ার লোকদের অপেক্ষা দ্বীনদার লোকরাই বেশী- ইহা এক মারাত্মক রোগের পরিচয় সন্দেহ নাই। এই রোগ যদিও চাকচিক্যপূর্ণ বহিরাবরণে আচ্ছাদিত ছিল, কিন্তু ইহার প্রাচীনত্ব সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নাই। আমরা যদি দাওয়াতকে নিছক একটি জ্ঞান ও গবেষণামূলক আন্দোলন হিসাবে পেশ করিতাম এবং এই উদ্দেশ্যকে বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করিবার চেষ্টা করিতে লোকদের আহবান জানাইতাম, তবে আমরা বলিতে পারি যে আমাদের এই কাজের বিরুদ্ধতা না হইয়া চতুর্দিক হইতে ইহার প্রশংসা ও ধন্যবাদের পুষ্প বর্ষিত হইত। খোদা ছাড়া অপর কাহারও দাসত্ব করা উচিত কিংবা মুসলমানদের মুনাফিকী ও ঈমান বিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকা উচিত অথবা মানব জীবনের কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব সৎ মুসলমানদের হাতে নহে- কাফিরদেরই করায়ত্ত থাকা উচিত- খোদার শরীয়াতের বদলে কাফিরী আইন দুনিয়ায় চলা উচিত- এই সব কথা কি কোন মুসলমান স্বীকার করিতে পারে? কিন্তু আমি পূর্ণ দৃঢ়তার সহিত বলিতে পারি, আজ পর্যন্ত আমরা যত কথাই বলিয়াছি, তাহার একটিও নিছক বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসাবে পেশ করি নাই, বরং সেই সঙ্গে তদানুযায়ী বাস্তব কাজেরও আহবান জানাইয়াছি। যদি তাহা না করিতাম, শুধু একটি তত্ত্ব হিসিবেই তাহা পেশ করিতাম, তবে একজন মুসলমানও উহার বিরুদ্ধে টু- শব্দটি করিতে সাহস পাইত না। কিন্তু ব্যাপার এই যে, আমরা তাহা করিতে পারি না। আমাদের দাওয়াত তো ঈমানের দৃষ্টিতে প্রত্যেক সত্যকে প্রথমত আমাদের নিজেদের জীবনে বাস্তবায়িত করা এবং পরে আমাদের বেষ্টনীতে ও সমগ্র পৃথিবীতে কার্যত কায়েম করা। ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে দেখিলে বলা যায়, ইতঃপূর্বে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনেও ঠিক এই ধরনেরই পরিস্হিতির উদ্ভব হইয়াছিল। 

জাহিলী আরবের কাব্য- সাহিত্য সম্পর্কে অভিজ্ঞ প্রত্যেক ব্যক্তিই স্বীকার করিবেন যে, হযরতের উপস্হাপিত তাওহীদ ও নৈতিক বিধান আরব দেশে কিছুমাত্র নতুন জিনিস ছিল না। অনুরূপ তাওহীদবাদী মতবাদ ও চিন্তাধারা জাহিলী যুগের অসংখ্য কবি এবং বক্তাও পেশ করিয়াছিল, ইসলামী নৈতিকতার অধিকাংশ কথা তাহারাও বলিয়াছিল। কিন্তু পার্থক্য ছিল এই যে, নবী করীম (সা.) নির্ভেজাল ও অবিমিশ্র সত্যকে একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্হা হিসাবে পেশ করিয়াছিলেন এবং প্রকৃত তাওহীদের বিপরীত ভাবধারাকে বাস্তব জীবন ক্ষেত্র হইতে দূর করিয়া দিয়া সমগ্র জীবনকে এই তাওহীদের ভিত্তিতে গঠন করার আহবান জানাইয়াছিলেন। সেই সঙ্গে নৈতিক চরিত্রের মূলনীতিসমূহকে পরিপূর্ণ বাস্তব জীবনের ভিত্তি হিসাবে কার্যত স্হাপিত করারও দাওয়াত দিয়াছিলেন। ঠিক এই জন্যই যে কথা বলা ও প্রচার করার কারণে বরং বাতিল ব্যবস্হার সহিত সংশ্লিষ্ট সকল সুযোগ-সুবিধাও পরিত্যাগ করিতে এবং পূর্ণ নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও সামঞ্জস্যের সহিত দ্বীন-ইসলাম অনুসরণ করিয়া চলিবার আহবান জানাই; উপরন্তু সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য জান-মাল, সময়-শ্রম সব কিছুই উৎসর্গ করিয়া চেষ্টা-সাধনা করিবার জন্যও যখন আহবান জানাই, তখন এই ‘মারাত্মক অপরাধ’ (?) যে বাস্তবিকই ক্ষমার যোগ্য নহে, তাহা সকলেই বুঝিতে পারেন।

 আমাদের কথা যদি সত্য বলিয়া মানিয়া লওয়া হয়। যদি বলা হয় যে, দ্বীন-ইসলামের ইহাই দাবী, ইহা পূরণের জন্য একনিষ্ঠ ও একমুখ হওয়া কর্তব্য, প্রকৃতপক্ষে বাতিল ব্যবস্হার সহিত ঈমানদার ব্যক্তিকে সমঝোতা নহে, সংঘর্ষের সৃষ্টি করিতে হইবে এবং সেই জন্য দ্বন্দ্ব-সংগ্রাম হওয়া বাঞ্ছনীয়, তাহা হইলে নিম্নলিখিত দুইটি উপায়ের যে কোন একটিকে গ্রহণ করা ভিন্ন আর কিছুই করিবার থাকে না। হয় নিজেদের স্বার্থের কোরবানী বরদাশত করিয়া কার্যত এই আন্দোলনে ঝাপাইয়া পড়িতে হয়, (কিন্তু এই কাজের তীব্রতা ও গুরুত্ব ভয়ানক) অথবা ইহাকে স্বীকার করার পর শুধু মনের দুর্বলতার দোহাই দিয়া এই আন্দোলন হইতে দূরে সরিয়া থাকিতে হয়।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url