Ad

মুক্তির পথ একটাই দাওয়াত ও জিহাদ।

প্রিয় ভাইগণ (طريق النجاة : الدعوة والجهاد)

মুক্তির পথ একটাই

প্রিয় ভাইগণ 

প্রথমে নিজের জীবনে ইসলামকে বাস্তবায়িত করে নিজেকে আদর্শ নমুনা হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু একাজ একেবারে নির্বিঘ্নে সম্ভব হবে না। যখনই আপনি জনগণকে দাওয়াত দিবেন এবং তা কায়েম করতে প্রয়াসী হবেন, তখনই আপনার সমাজ এমনকি আপনার পরিবার আপনার উপর ক্ষেপে যাবে। বরং বলা যেতে পারে যে, জাহেলিয়াত তার সমগ্র হাতিয়ার নিয়ে আপনার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এমতাবস্থায় আপনাকে তিনটি বস্ত্ত সর্বদা মনে রাখতে হবে-

(১) নিজেকে সব সময় জাহেলিয়াতের ময়দানে যুদ্ধরত সৈনিক মনে করা। 

(২) শাহাদাত পিয়াসী সৈনিকের বাঁচার জন্য যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকুতে সন্তুষ্ট থাকা।

 (৩) নিজের কর্ম ও আচরণ কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হওয়া। 

আল্লাহর ঘোষণা শুনুন-

أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَعْلَمِ اللهُ الَّذِينَ جَاهَدُوا مِنْكُمْ وَيَعْلَمَ الصَّابِرِينَ- (آل عمران ১৪২)-

‘তোমরা কি ভেবেছ জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ আল্লাহ এখনো জেনে নেননি কারা তোমাদের মধ্যে জিহাদ করেছে এবং কারা তোমাদের মধ্যে ধৈর্যশীল’? (আলে ইমরান ৩/১৪২)

‘জিহাদ’ অর্থ আল্লাহর পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো। ‘শহীদ’ অর্থ আল্লাহর পথে নিহত অথবা মৃত্যুবরণকারী। জিহাদ মুমিনের প্রতি মুহূর্তের সঙ্গী। যেখানেই সে অন্যায় দেখবে, সেখানেই সে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করবে।

 জিহাদকে বাদ দিয়ে মুমিন হিসাবে এ জগতে বেঁচে থাকা অসম্ভব। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘জিহাদ ও সংকল্প (অর্থাৎ জিহাদের খালেছ নিয়ত) চিরদিন  বাকী  থাকবে’। শয়তানের আয়ু ক্বিয়ামত পর্যন্ত দীর্ঘ।  অতএব যতদিন শয়তান বেঁচে থাকবে, ততদিন তার বিরুদ্ধে জিহাদ থাকবে। 

বুখারী হা/৩১৮৯, ২৭৮৩; মুসলিম হা/১৩৫৩, ১৮৬৪; মিশকাত হা/২৭১৫।

জিহাদের প্রকৃতি

জিহাদ থেকে যিনি পিছিয়ে আসবেন কিংবা অলসতা প্রদর্শন করবেন, তিনি শয়তানের সঙ্গে মিতালী করবেন এবং আল্লাহর গযবের শিকার হবেন। আল্লাহ বলেন,

يَآ أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ لاَ تَتَّخِذُواْ آبَاءَكُمْ وَإِخْوَانَكُمْ أَوْلِيَاءَ إِنِ اِسْتَحَبُّوا الْكُفْرَ عَلَى الإِيمَانِ وَمَنْ يَّتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الظَّالِمُوْنَ- قُلْ إِنْ كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَآؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيْرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوْهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُم مِّنَ اللّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِيْ سَبِيْلِهِ فَتَرَبَّصُوْا حَتَّى يَأْتِيَ اللهُ بِأَمْرِهِ، وَاللهُ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِيْنَ- (الةوبة ২৩-২৪)-

‘হে মুমিনগণ! তোমরা তোমাদের পিতা ও ভাইদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, যদি তারা ঈমানের মুকাবিলায় কুফরকে প্রিয় মনে করে। তোমাদের মধ্যে যারা তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তারাই সীমালংঘনকারী’। ‘বলে দাও, তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা, পুত্র, ভাই, স্ত্রী, স্বগোত্র ও ধন-সম্পদ

 যা তোমরা অর্জন কর, ব্যবসা যা তোমরা বন্ধ হবার আশংকা কর এবং বাড়ী-ঘর যা তোমরা ভালোবাস- আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর   রাস্তায় জিহাদ করার চাইতে অধিক প্রিয় হয়, তাহ’লে তোমরা অপেক্ষা কর আল্লাহর নির্দেশ (আযাব) আসা পর্যন্ত। বস্ত্ততঃ আল্লাহ পাপাচারী সম্প্রদায়কে সুপথ প্রদর্শন করেন না’ (তাওবাহ ৯/২৩-২৪)

(كيفية الجهاد)

বর্তমানে ‘জিহাদ’ এবং ‘শহীদ’ শব্দ দু’টি স্থানে-অস্থানে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রত্যেক দলই নিজেদের দলীয় স্বার্থে কাজ করাকে ‘জিহাদ’ ভাবেন এবং অপর দলের হাতে তাদের দলের কোন কর্মী মারা গেলে তাকে ‘শহীদ’ বলে আখ্যায়িত করেন। আসুন, এ বিষয়ে  আমরা ২য় খলীফা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর নিকট থেকে জওয়াব নিই। 

একদা এক খুৎবায় ওমর ফারূক (রাঃ) বলেন, কেউ যুদ্ধে নিহত হ’লে বা মারা গেলে তোমরা বলে থাক যে, ‘অমুক লোক শহীদ হয়ে গেছে’। তোমরা এরূপ বলো না। বরং ঐরূপ বল যেরূপ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলতেন,مَنْ قُتِلَ فِى سَبِيْلِ اللهِ فَهُوَ شَهِيْدٌ وَمَنْ مَاتَ فِى سَبِيْلِ اللهِ فَهُوَ شَهِيْدٌ ‘যে আল্লাহর রাস্তায় নিহত হ’ল সে ব্যক্তি শহীদ এবং যে আল্লাহর রাস্তায় মৃত্যু বরণ করল সে ব্যক্তি শহীদ’।

[1] কেননা কোন্ ব্যক্তি কোন্ নিয়তে জিহাদ  করেছে, সে খবর একমাত্র আল্লাহ ভাল জানেন। খালেছ আল্লাহর ওয়াস্তে জিহাদ হওয়াটাই এখানে বড় কথা। দুনিয়াবী কোন স্বার্থে নয়।

অতঃপর জিহাদ সম্পর্কে ‘মুমিনের সংগ্রাম রাজনৈতিক নয় বরং আক্বীদা ও বিশ্বাসের সংগ্রাম’- প্রসঙ্গে সাইয়িদ কুতুব (১৯০৬-৬৬ খৃ.) বলেন,[2] 

‘ঈমানদারগণ ও তাদের প্রতিপক্ষের মধ্যে যে সংগ্রাম অবিরতভাবে চলছে, এটা স্রেফ আক্বীদার সংগ্রাম, আদৌ অন্য কিছু নয়। তাদের শত্রুরা তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয় স্রেফ ঈমানের কারণে। তারা তাদের উপর ক্রুদ্ধ হয় স্রেফ আক্বীদার কারণে। এটি কোন রাজনৈতিক সংগ্রাম নয়, অর্থনৈতিক সংগ্রাম নয় বা কোন জাতি-গোষ্ঠীগত সংগ্রাম নয়।

যদি এসবের সামান্য কিছুও হ’ত, তাহ’লে তা মিটানো সম্ভব হ’ত এবং তার সমাধান সহজ হ’ত। কিন্তু সঠিক কথা এই যে, এটি হ’ল আক্বীদা-বিশ্বাসের সংগ্রাম। হয় কুফর থাকবে, নয় ঈমান থাকবে। হয় জাহেলিয়াত থাকবে, নয় ইসলাম থাকবে’।[3]  

প্রিয় ভাইগণ 

নবীগণের ইতিহাস স্মরণ করুন। তারা কারো রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থে ভাগ বসাতে যাননি।

মুক্তির পথ একটাই

তাঁদের আমলের প্রতিষ্ঠিত শাসন শক্তিকে উৎখাতের চেষ্টা করেননি। তাহ’লে কেন তখনকার সমাজ সর্বশক্তি নিয়ে তাঁদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল?

 কেন তাঁদেরকে বেঁধে করাতে চিরে হত্যা করেছিল? 

কেন জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে জীবন্ত নিক্ষেপ করেছিল? 

কেন আমাদের নবী (ছাঃ)-কে দেশ ছাড়তে হয়েছিল? 

কেন ‘আছহাবুল উখদূদ’-এর কয়েক হাযার ঈমানদার নর-নারীকে একই দিনে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হ’ল?

জওয়াব আল্লাহর কাছ থেকেই নিন-وَمَا نَقَمُوا مِنْهُمْ إِلاَّ أَنْ يُؤْمِنُوا بِاللهِ الْعَزِيزِ الْحَمِيدِ- ‘তারা তাদের থেকে প্রতিশোধ নিয়েছিল কেবল এ কারণে যে, তারা বিশ্বাস স্থাপন করেছিল মহাপরাক্রান্ত ও মহাপ্রশংসিত আল্লাহর উপরে’ (বুরূজ ৮৫/৮)

বলাবাহুল্য ঈমান ও কুফর, ইসলাম ও জাহেলিয়াত কখনো একত্রে বাস করতে পারে না। বর্তমানে মুসলিম সমাজে ব্যাপক অধঃপতনের মূল কারণ হ’ল জিহাদবিমুখতা। আর জিহাদবিমুখতার প্রধান কারণ হ’ল আপোষ কামিতা। তথাকথিত ‘হেকমতের’ দোহাই পেড়ে সর্বত্র জাহেলিয়াতের সঙ্গে আমরা আপোষ করে চলেছি।

কি আলেম কি সমাজনেতা সবাই যেন আমরা একই রোগে ভুগছি। আমরা আপোষ করেছি ধর্মীয় ক্ষেত্রে ‘তাক্বলীদে শাখছী’র সঙ্গে, যা কুরআন ও সুন্নাহর নিরপেক্ষ অনুসরণের ক্ষেত্রে সবচাইতে বড় বাধা। আমরা আপোষ করেছি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতা, সামরিকতন্ত্র ও পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের সাথে- যা ইলাহী সার্বভৌমত্বের সম্পূর্ণ বিরোধী। 

আমরা আপোষ করেছি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের সাথে, যা ইসলামী অর্থনীতির সম্পূর্ণ বিপরীত। আমরা আপোষ করেছি সমাজ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা রসম-রেওয়াজের সঙ্গে, যা ইসলামী সংস্কৃতির সাথে অনেক ক্ষেত্রে বিরোধপূর্ণ।

প্রিয় ভাইগণ 

আমাদেরকে অবশ্যই আপোষকামী মনোভাব ত্যাগ করতে হবে। যেমন করেছিলেন আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাঁর মাক্কী জীবনে। জাহেলী সমাজে বসবাস করেও তিনি জাহেলিয়াতের সঙ্গে আপোষ করেননি। সমাজ তাঁকে একঘরে করেছে। তাঁর জন্য বাজার নিষিদ্ধ করেছে। গাছের ছাল-পাতা খেয়ে তিনি জীবন ধারণ করেছেন। 

তথাপি সমাজের সঙ্গে আপোষ করেননি। মর্মান্তিক অগ্নি পরীক্ষা সত্ত্বেও আপোষ করেননি ইবরাহীম (আঃ) তৎকালীন সমাজ ও সরকারের সাথে। শুধু পিতা ইবরাহীম কেন দুনিয়ার সকল নবীর ইতিহাস জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে আপোষহীন জিহাদের ইতিহাস। 

কোন নবীই স্বীয় জীবনে স্বীয় সমাজে মেজরিটির সমর্থন পাননি। এমনকি ক্বিয়ামতের দিন কোন কোন নবী একজন বা দু’জন উম্মত নিয়ে অথবা উম্মত ছাড়াই উপস্থিত হবেন।[4]

সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন না পাওয়ার অর্থ কি তাঁরা বাতিলপন্থী ছিলেন? (নাঊযুবিল্লাহ)। তাঁরা ক্ষমতা ও পদমর্যাদার লড়াই করেননি। তাঁরা চেয়েছিলেন আল্লাহর পাঠানো অভ্রান্ত সত্যকে সমাজের সামনে তুলে ধরতে। হক-এর আওয়াযকে বুলন্দ করতে। সত্যকে সত্য হিসাবে এবং বাতিলকে বাতিল হিসাবে চিহ্নিত করতে।

আমাদেরকেও নবীগণের পথ বেছে নিতে হবে। সে পথ ভোটারের মনস্ত্তষ্টির পথ নয়, সে পথ আল্লাহর সন্তুষ্টির পথ। সে পথ শুধু চেয়ার পরিবর্তনের পথ নয়, সে পথ সমাজ পরিবর্তনের পথ, সমাজ বিপ্লবের পথ, আপোষহীন জিহাদের পথ।

[1]. আহমাদ হা/২৮৫, ১০৭৭২; ইবনু মাজাহ হা/২৯১০; মুসলিম হা/১৯১৫, মিশকাত হা/৩৮১১; ফাৎহুল বারী ‘এ কথা বলা হবে না যে, অমুক ব্যক্তি শহীদ’ অনুচ্ছেদ, হা/২৭৪১-এর পূর্বে।

[2]. বর্ণনাটি নিম্নরূপ :

إن المعركة بين المؤمنين وخصومهم هى فى صحيحها معركة عقيدة وليست شيئا آخر على الإطلاق وان خصومهم لاينقمون منهم الا الايمان ولايسخطون منهم الا العقيدة- انها ليست معركة سياسية ولا معركة اقتصادية ولا معركة عنصرية ولو كانت شيئا من هذا لسهل وقفها وسهل حل إشكالها ولكنها فى صحيحها معركة عقيدة، إما كفر وإما إيمان، إما جاهلية وإما إسلام- معالم فى الطريق، ط-بيروت ১৯৮৩ ص ২০১-

[3]. সাইয়েদ কুতুব, মা‘আলিম ফিত ত্বরীক্ব (বৈরূত ছাপা : ১৯৮৩), ২০১ পৃঃ।

এর অর্থ এটা নয় যে, কোন ঈমানদার ব্যক্তি কবীরা গোনাহ করবে না। করলে সে কাফের হয়ে যাবে এবং তার রক্ত হালাল হবে’। কেননা এরূপ চরমপন্থী আক্বীদা হ’ল ভ্রান্ত ফিরক্বা খারেজীদের আক্বীদা। যারা ৪র্থ খলীফা হযরত আলী (রাঃ)-কে হত্যা করেছিল নেকীর কাজ মনে করে। 

এই আক্বীদার বিরুদ্ধে রাসূল (ছাঃ)-এর কঠোর ভবিষ্যদ্বাণীসমূহ রয়েছে (মুসলিম হা/১০৬৪ (১৪৭-৪৮); হা/১০৬৬ (১৫৪)। আধুনিক যুগে অনুরূপ আক্বীদার লোকদেরকে বিদ্বানগণ ‘জামা‘আতুত তাকফীর’ (جماعة التكفير) অর্থাৎ কাবীরা গোনাহের কারণে ‘অন্যকে কাফের ধারণাকারী দল’ বলে অভিহিত করে থাকেন।

 অথচ এরূপ চরমপন্থী আক্বীদার ফলে যিনি মারছেন ও যিনি মরছেন, উভয়ে মুসলমান। আর এটাই তো শয়তানের পাতানো ফাঁদ, যেখানে তারা পা দিয়েছেন। বস্ত্ততঃ মাওলানা মওদূদী ও সাইয়িদ কুতুব ছিলেন উক্ত আক্বীদারই অনুসারী (দ্র. ‘জিহাদ ও ক্বিতাল’ বই, ২য় সংস্করণ ৫২-৫৫ পৃ.)। 

[4]. বুখারী হা/৫৭৫২; মুসলিম হা/২২০; মিশকাত হা/৫২৯৬ ‘তাওয়াক্কুল ও ছবর’ অনুচ্ছেদ।

জিহাদের হাতিয়ার(أسلحة الجهاد)

ইসলামী পরিভাষায় জিহাদের তাৎপর্য চিরকাল একই থাকবে। তবে জিহাদের পদ্ধতি পরিবর্তনশীল। অসিযুদ্ধ এখুনি নয়। মসীযুদ্ধ অসির চাইতে মারাত্মক। ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (৬৬১-৭২৮ হি./১২৬৩-১৩২৮ খৃ.)-কে জেলখানায় আটকে রেখেও সরকার নিশ্চিন্ত হ’তে না পেরে তাঁর কাগজ-কলম কেড়ে নিয়েছিল। 

বাধ্য হয়ে জেলখানার বাবুর্চির সৌজন্যে কিছু কয়লা সংগ্রহ করে তাই দিয়ে নিজ কক্ষের দেওয়াল কুরআন ও সুন্নাহর কালি দিয়ে আলোকিত করেছিলেন। অবশেষে জেলখানাতেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।বাতিল শক্তিগুলি যে সব হাতিয়ার নিয়ে হক-কে মিটিয়ে ফেলার চেষ্টায় রত, আমাদেরকে ওহোদের ময়দানের ন্যায় বাতিলের হামলার সেসব অলি-গলিতে সতর্ক প্রহরায় থাকতে হবে। 

এ যুগে জিহাদের সর্বাপেক্ষা বড় হাতিয়ার হ’ল তিনটি : কথা, কলম ও সংগঠন। আপনাকে অবশ্যই কথা বলা শিখতে হবে। যদি ‘টেবিল টক’-এ পটু হন, সেটা করুন। যদি স্টেজ-এর বক্তৃতায় পারঙ্গম হন, তবে তাই করুন। ইল্মের ডিপো হয়ে বসে থাকলে চলবে না। দাওয়াত দিন।  

মানুষের নিকট  হক-এর  আহবান  পৌঁছে দিন।  যে  কোন  সমস্যায় কুরআন ও সুন্নাহ থেকে সমাধান নিন। দ্বীনের ব্যাপারে কপোল কল্পিত কোন কথা বলবেন না। কুটতর্কে জড়াবেন না।

লিখুন। আপনার লেখা মানুষের হৃদয়তন্ত্রীতে আঘাত হানুক। সেখানে ঝংকার উঠুক। সমাজ বিপ্লবের অগ্নিশিখা জ্বলে উঠুক। ঘুণে ধরা আক্বীদায় পরিবর্তন আসুক। আপনার বই ছিঁড়ে ফেলুক, দুঃখ নেই। কিন্তু সাথে সাথে হৃদয়ে লালিত জাহেলিয়াতের অন্ধকার যেন ছিঁড়ে খান খান হয়ে যায়। বিদেশী ভাষা শিখুন।

 কিন্তু মায়ের ভাষায় বলুন ও লিখুন। কেননা আল্লাহ আপনাকে-আমাকে এদেশেই দ্বীন প্রচারের জন্য মনোনীত করেছেন। ফালিল্লা-হিল হাম্দ।বিচ্ছিন্ন জনগণ যখন একটি আদর্শমূলে একই লক্ষ্যে একই নেতৃত্বের অধীনে সংগঠিত হয়, তখন সেটি একটি জনশক্তিতে পরিণত হয়। 

আমাদেরকে অবশ্যই একটি সংঘবদ্ধ জনশক্তি হিসাবে, একটি ঐক্যবদ্ধ সামাজিক শক্তি হিসাবে গড়ে উঠতে হবে। এদেশের বাতিলপন্থীরা তাদের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ। হকপন্থীদের তাদের করুণার ভিখারী হয়ে বেঁচে থাকার কোন অবকাশ নেই।

মুক্তির পথ একটাই

আন্দোলন অথবা ধ্বংস(الحركة او الهلكة)

কথা, কলম ও সংগঠন- জিহাদের এই ত্রিমুখী হাতিয়ার নিয়ে আমাদেরকে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। আল্লাহ বলেন, يَآ أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِنْ تَنصُرُوا اللهَ يَنْصُرْكُمْ وَ يُثَبِّتْ أَقْدَامَكُمْ- (محمد ৭)- ‘হে বিশ্বাসীগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য করো, আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পাগুলিকে দৃঢ় রাখবেন’ (মুহাম্মাদ ৪৭/৭)। অতএব ‘আল্লাহ তার দ্বীনকে হেফাযত করবেন’। 

অতএব আপনার-আমার কিছুই করণীয় নেই- এ ধরনের ধোঁকা হ’তে দূরে থাকুন। আল্লাহ যেমন দ্বীনের মালিক, তেমনি আপনার রূযীরও মালিক। কিন্তু রূযী কামাইয়ের বেলায় তো আপনি ঘরে চুপচাপ বসে থাকেন না। বিনা প্রচেষ্টায় যদি রূযী আপনার ঘরে না আসে, তাহ’লে বিনা প্রচেষ্টায় দ্বীন কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে? 

তীব্র স্রোতের মুখে দুর্বল বাঁধের যেমন কোন অস্তিত্ব থাকে না, সর্বব্যাপী জাহেলিয়াতের তীব্র স্রোতের মুখে হকপন্থীদের প্রতিরোধ যদি মযবুত না হয়, তাহ’লে তারাও তেমনি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তখন ঐ দায়িত্ব আল্লাহ অন্য লোকদের হাতে ন্যস্ত করবেন, আমরা মাহরূম হব। 

যেমন আল্লাহ বলেন,

إِلاَّ تَنْفِرُوْا يُعَذِّبْكُمْ عَذَابًا أَلِيْمًا وَّيَسْتَبْدِلْ قَوْمًا غَيْرَكُمْ وَلاَ تَضُرُّوْهُ شَيْئًا وَاللهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ- (التوبة ৩৯)-

‘যদি তোমরা (জিহাদে) বের না হও, তবে আল্লাহ তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রদান করবেন এবং অন্য কওমকে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন। যাদেরকে তোমরা কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। বস্ত্ততঃ আল্লাহ সকল বিষয়ের উপর ক্ষমতাশালী’ (তওবা ৯/৩৯)

 অতএব হয় আন্দোলন, নয় ধ্বংস, যে কোন একটি পথ বেছে নেওয়ার দায়িত্ব আপনার-আমার।

জান্নাতের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়

(طريق الجنة ليس زهرىُّ)

মধু পেতে গেলে মৌমাছির কামড় সহ্য করতে হয়। গোলাপ আহরণ করতে গেলে আঙ্গুলে কাঁটা ফোটার জন্য প্রস্ত্তত থাকতে হয়। জান্নাত পেতে গেলে তেমনি কাঁটা বিছানো রাস্তায় চলতে হবে। বিলাসিতাকে ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করতে হবে। 

সকল প্রকারের রিয়া ও অহংকার পায়ের তলে দাবাতে হবে। আল্লাহর ওয়াস্তে সকল কষ্ট হাসি মুখে বরণ করে নিতে হবে। আল্লাহ বলেন,

أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُم مَّثَلُ الَّذِيْنَ خَلَوْا مِنْ قَبْلِكُم مَّسَّتْهُمُ الْبَأْسَآءُ وَالضَّرَّآءُ وَزُلْزِلُواْ حَتَّى يَقُوْلَ الرَّسُوْلُ وَالَّذِيْنَ آمَنُواْ مَعَهُ مَتَى نَصْرُ اللهِ أَلآ إِنَّ نَصْرَ اللهِ قَرِيْبٌ- (البقرة ২১৪)-

‘তোমরা কি ধারণা করেছ জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ তোমাদের উপর এখনও তাদের মত অবস্থা আসেনি, যারা তোমাদের পূর্বে বিগত হয়েছে। নানাবিধ বিপদ ও দুঃখ-কষ্ট তাদেরকে স্পর্শ করেছিল ও তারা ভীত-কম্পিত হয়েছিল। অবশেষে রাসূল ও তার সাথী মুমিনগণ বলতে বাধ্য হয়েছিল যে, কখন আল্লাহর সাহায্য আসবে? জেনে রাখ, নিশ্চয়ই আল্লাহর সাহায্য অতীব নিকটবর্তী’ (বাক্বারাহ ২/২১৪)

নবীগণ ও তাঁদের সাথীদের যদি এমন অবস্থা হয়, তাহ’লে জাহেলিয়াত যখন মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগে দৃঢ়ভাবে জেঁকে বসে আছে, সে অবস্থায় আমাদের মত গোনাহগারদের আরও কত গুণ বেশী কষ্ট ও মুছীবতের সম্মুখীন হ’তে হবে?

মুমিনের জন্য পার্থিব বিজয় লাভ অপরিহার্য নয়

(حصول على الدنيا لا يلزم للمؤمن)

আর একটি কথা সর্বদা মনে রাখতে হবে যে, মুমিনের জন্য পার্থিব বিজয় লাভ যরূরী নয়। আমরা আমাদের আন্দোলনের বিনিময়ে দুনিয়ায় কিছু চাই না। সবকিছু আখেরাতে চাই। আল্লাহ বলেন,

مَنْ كَانَ يُرِيْدُ حَرْثَ الْآخِرَةِ نَزِدْ لَهُ فِيْ حَرْثِهِ وَمَنْ كَانَ يُرِيْدُ حَرْثَ الدُّنْيَا نُؤتِهِ مِنْهَا وَمَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِن نَّصِيْبٍ- (الشورى ২০)-

‘যে কেউ পরকালের ফসল কামনা করে, আমরা তার ফসল বাড়িয়ে দেই। আর যে ব্যক্তি ইহকালের ফসল কামনা করে, আমরা তাকে সেখান থেকে কিছু দিয়ে থাকি। কিন্তু পরকালে তার কোনই অংশ থাকবে না’ (শূরা ৪২/২০)

এরপরেও যদি আমরা কখনো পার্থিব বিজয় লাভ করি, তবে তাতে ধোঁকা খাওয়ার কিছুই থাকবে না। কেননা পার্থিব বিজয় লাভ মুমিনের আন্দোলনের প্রতিদান নয় বরং আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ মাত্র। আমরা বলব, ওটা আমাদের ঈমানের পরীক্ষাও হ’তে পারে। মনে রাখতে হবে যে, ক্ষমতা দেওয়ার মালিক আল্লাহ। যেমন তিনি বলেন,

قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَنْ تَشَآءُ وَتَنْزِعُ الْمُلْكَ مِمَّنْ تَشَآءُ وَتُعِزُّ مَنْ تَشَآءُ وَتُذِلُّ مَنْ تَشَآءُ بِيَدِكَ الْخَيْرُ، إِنَّكَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ-

‘তুমি বল, হে আল্লাহ! তুমি রাজাধিরাজ। তুমি যাকে খুশী রাজত্ব দান কর ও যার কাছ থেকে খুশী রাজত্ব ছিনিয়ে নাও। তুমি যাকে খুশী সম্মানিত কর ও যাকে খুশী অপমানিত কর। তোমার হাতেই যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয় তুমি সকল কিছুর উপরে ক্ষমতাবান’ (আলে ইমরান ৩/২৬)

অতএব আসুন! শুধু রাজনীতি নয়, শুধু অর্থনীতি নয়, বরং সর্বাত্মক সমাজ বিপ্লবের লক্ষ্যে আমরা নবীদের তরীকায় এগিয়ে চলি। আমাদের জান-মাল, সময়-শ্রম, শিক্ষা, জ্ঞান-বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তি তথা আল্লাহর দেওয়া আমাদের সকল প্রিয় বস্ত্তকে পিতা ইবরাহীমের ন্যায় আল্লাহর রাহে উৎসর্গ করি। আল্লাহ বলেন,

قُلْ إِنَّ صَلاَتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ- (الأنعام ১৬২)-

‘বল, আমার ছালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ, সবই জগত সমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য’ (আন‘আম ৬/১৬২)

আসুন! আমরা পুনরায় উচ্চারণ করি ইসলামী সমাজ বিপ্লবের সেই দুনিয়া কাঁপানো শ্লোগান...‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ’। জীবনের কোন ক্ষেত্রে ‘নেই কোন ইলাহ কেবলমাত্র আল্লাহ ব্যতীত’। পরিশেষে যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য এবং সকল দরূদ ও সালাম তাঁর শেষনবী মুহাম্মাদ ও তাঁর পরিবার ও ছাহাবীগণের জন্য।

وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين و صلى الله على نبينا محمد و آله و صحبه و سلم- سبحانك اللهم وبحمدك أشهد أن لا إله إلا أنت أستغفرك وأتوب إليك، اللهم اغفرلى ولوالدىّ وللمؤمنين يوم يقوم الحساب-

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url